অদৃশ্য হয়ে যাবার কথা ভেবেছেন কখনো? আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, সবার মাঝ দিয়ে আমি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি। কি দুর্দান্ত হতো, তাই না?
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, যেখানে পথে নামলেই গায়ে গা ঠেকিয়ে হেঁটে চলা অগণিত ব্যস্ত মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, সেই শহরে অদৃশ্য হয়ে যেতে কী করতে হয়?
ঘরের দরজা খুলে বাইরে বের হওয়ামাত্র, একটা মেয়ে টের পায়, অগণিত জোড়া জোড়া চোখ লক্ষ্য করছে তাকে। কেউ নজর পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, কেউ মুখের আদলটা দেখে নেয় একটুখানি, কারও দৃষ্টি স্ক্যানারের মতো স্ক্যান করে যায় মেয়েটার সর্বাঙ্গ। এদের মধ্যে বেশ কয়েক জোড়া চোখ, ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। এই টের পাওয়াটুকু, অসংখ্য জোড়া জোড়া চোখের ফোকাস বিন্দুতে থাকার অস্বস্তিটুকুর সাথে আমরা মানিয়ে গিয়েছি, এটা এখন আমাদের প্রাত্যহিক চলাফেরার সঙ্গে মিশে গেছে।
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, একটা মেয়ের অদৃশ্য হয়ে যেতে কী করতে হয়?
আমি বলে রাখছি, এটা নিতান্তই আমার নিজস্ব এবং কাকতালীয় একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিজস্ব কিছু বক্তব্য মাত্র। আমি কাউকে এটা করতে উৎসাহিত করছি না।
শীতের সন্ধ্যা। কোনো একটা কাজ সেরে ফিরছি। রিকশায় বসে আমি, চোখে চশমা, পরনে নীল জিন্স। গায়ে একটা কোমর অব্দি লম্বা কালো ফতুয়ার ওপরে ভারী হুডি সোয়েটার চড়িয়ে রেখেছি। পায়ে আমার নিত্য সঙ্গী রঙচটা কনভার্স জুতো।
এই শহরেরই কোনো ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে রিকশা যাচ্ছে আমার, রিকশার হুড অবহেলায় ফেলে রাখা, আমার সারা জীবনের অভ্যেস। কী মনে হতে, আমি আমার সোয়েটারের হুড তুলে দিলাম মাথায়। আমার অবিন্যস্ত চুলগুলো ঢেকে গেলো, চশমা পড়া চোখ আড়াল হয়ে গেলো কালো হুডের নিচে, মুখমণ্ডলের একমাত্র দৃশ্যমান অংশ বলতে রইলো আমার চোয়ালটুকু, সেই সাথে হাতের কবজি অব্দি খোলা।
কয়েক মিনিট পরে আমার চমকাবার পালা। কিছু একটা বদলে গেছে। কিছু একটা আর আগের মতো নেই। আমি খেয়াল করলাম, আমার দিকে আর কেউ তাকাচ্ছে না। কেউ না।
আমি অদৃশ্য! অগণিত জোড়া চোখের ফোকাস বিন্দু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে পারার সেই অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিটুকু ছিলো অন্যরকম। যেন অন্য একটা ভাষা, আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ফুটিয়ে বলতে পারছি না। আমি বোঝাতে পারবো না সেই ভালোলাগাটুকুর কথা।
খেয়াল করুন, সেই মুহূর্তে, পোশাকে আশাকে আমার সাথে কোনো পুরুষের পার্থক্য ছিলো না। দেড় কোটি মানুষের (!) এই শহরে, পচাত্তর লাখ সাধারণ(!) পুরুষের কাতারে চলে গিয়েছিলাম আমি, হয়ে গিয়েছিলাম নজরের আড়াল।
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, একজন মেয়ে হিসেবে অবজেকটিফাইড না হবার সেই কয়েকটা মিনিট, আমার জীবনের স্মরণীয় সময়গুলোর মধ্যে তোলা থাকবে।
No comments:
Post a Comment