Wednesday, January 30, 2013

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যাগুলো


আজকের আকাশের চেহারাটাও সেদিনের মতনই। সেই সকাল থেকেই রং বদলাচ্ছে আজও। সেদিন যেমন ঠিক সক্কাল বেলাটায় রোদ্দুর খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিলো! তারপরে ক্লান্ত দুপুর শেষে ধীরে ধীরে ধূসর মেঘরঙে ছেয়ে গিয়েছিলো প্রিয় আকাশটা। আর সন্ধ্যা না নামতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আজকের সকালজুড়েও গনগনে রোদ্দুরের প্রখর উত্তাপ ছেয়ে ছিলো। বেলা যত গড়াচ্ছে ধীরে ধীরে মেঘলা হয়ে আসছে আকাশ। সন্ধ্যা হতেই হয়তবা শুরু হবে বৃষ্টিটা। ঠিক সেদিনের মতনই। তফাত শুধু এইটুকুই সেদিনের মতন সন্ধ্যা সাতটা বাজার পরে আজ বৃষ্টির পাশে থাকবে না নীলয়। সেই কবেকার কথা! আজও চোখ বুঁজলে মনের পর্দায় স্বচ্ছ আয়নার মতন ভেসে আসে সেই সন্ধ্যাটি। মাঝে কতগুলো আষাঢ় এলো আর গেলো। কিন্তু অনেক বছর আগের সেই আষাঢ়ে সন্ধ্যাটি বুঝি স্মৃতির পাতায় আটকে গেলো। এমনি করেই যায় বুঝিবা... 

সেই সন্ধ্যার আগের দিনটাতেও জ্বরটা প্রবল ছিলো। বিছানা থেকে মাথা তোলার সাধ্যি ছিলো না একেবারেই। সেদিন যা একটু কমেছিলো জ্বরটা। সন্ধ্যের মুখেই মা এসে বললেন, আদিত্য এসেছে। সাথে নীলয়। সারা শরীর এক অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে কেঁপে ওঠে। যার সাথে এ কটা দিন শুধু ফোনেই কথা হলো আজ তাকে সশরীরে দেখতে পাওয়ার অপ্রত্যাশিত আনন্দেই যেন শরীরটা অনেকখানি সেরে গেলো। এক পলকের জন্যে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে বড্ড এলোমেলো মনে হলো। দুদিনের জ্বরে মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গিয়েছে। পরিচর্যার অভাবে বিবর্ণ-রুক্ষ হয়ে আছে পিঠের উপরে একরাশ চুলের বোঝা। বিছানা ছেড়ে ঝটপট মুখ হাতে পানি দিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিতে আর হুইলচেয়ারের চাকায় গড়িয়ে সামনের রুমে যেতে সব মিলিয়ে সময় নিলো মিনিট পনেরো। কিন্তু এইটুকুন সময়েই হৃদপিণ্ডটা জোরসে লাফিয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলো বৃষ্টির। 

প্রথম চোখাচোখি দু'জোড়া চোখের। মুহূর্তটা ভুলতে পারেনি কখনোই। যেন এই সেদিনের ঘটনা। তাকে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে খ্রীষ্টীয় কায়দায় প্রণাম দিচ্ছিলো নীলয়। চেহারায় ছড়িয়ে ছিলো মায়াবী সেই হাসিটা। সত্যিই যেন স্বর্গ থেকে স্বয়ং যিশু নেমে এসেছেন! হলুদ চেকের বিস্কিট কালারের সেই শাটর্টি জড়িয়ে ছিলো নীলয়কে। বৃষ্টিভেজা এলোমেলো অবাধ্য চুলগুলো কপালের ওপরে গড়িয়ে পড়ছিলো বারে বারে। আর খানিকবাদে বাদেই নীলয়ের হাতের আঙুলগুলো উঠে যাচ্ছিলো সেখানটায়। সেদিন বৃষ্টির কেন যেন মনে হচ্ছিলো আগেও বহুবার বুঝি দেখেছে সে এ দৃশ্য। এমনটাই যেন হবার কথা ছিলো। ঠিক এমনি করেই। মুহূর্তের জন্যে যেন থমকে গিয়েছিল সময়টা। অনন্তকাল ধরে তারা একে অপরকে চেনে। জানে। বোঝে। কখন কীভাবে যে তাদের অবাধ্য দু' মন এক হয়ে গেলো! বৃষ্টির শত চেষ্টা, বিধিনিষেধ কোনোটাই মন মানেনি। শুধু অনুভব করেছে এই মানুষটার ওপরে প্রবল অধিকারবোধ জন্মেছে তার। অনেক অ-নেক কষ্ট দিতে পারে এই মানুষটিকে সে। আবার পরম মমতায় আগলেও ধরতে পারে। নিজের শারীরিক অক্ষমতার কথা ভেবে যদিবা একটু ভয় পেত। কোথা থেকে নীলয় এসে প্রবল ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত ওকে সুদূর স্বপ্নপুরীতে। সেখানে তাদের ঝাউ গাছটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর ধারে বসে ইটুস পিটুস গল্পে ডুবে যেতো দু'জনে। রঙ বেরঙের পাখিরা সব উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াত চারিপাশে। ক্লান্তি লাগলেই বিরাটাকায় বটগাছের ডালে ঝোলানো দোলনায় বসে থাকা, কবিতা আর গান। ঝাউগাছের শনশন আওয়াজ, হাওয়ায় ভেসে আসা পাতার মর্মর ধ্বনি আর নাম না জানা সব পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হতো সকাল- দুপুর- বিকেলগুলো। সারাদিন সারাবেলা এক অলৌকিক সুরের মূর্ছনায় বুঁদ হয়ে থাকা। একেই কি বলে সত্যিকারের ভালোবাসা! নতুবা যে বৃষ্টি কবিতার নাম শুনেই পালাত সে এমন চমৎকার আবৃত্তি কীভাবে করে! গল্প উপন্যাসের বদলে কেনইবা তার টেবিলে জমা হতে থাকে কবিতার বই! শুধুই কি নীলয়ের পছন্দ বলে!

সারাটা দিনের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতো ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে। এক ঝটকায় সামনে পড়ে থাকা কর্ডলেসটা তুলে নিতে তার এতটুকুনও সময় লাগত না। রাজ্যির গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলে পরে সময়ের খবর থাকত না আর। সে বছর বর্ষা হয়েছিলো সত্যিই দেখবার মতন। বৃষ্টির সুখ বুঝি আকাশের সহ্য হয়নি। তাই কি, আকাশের যতটুকুন কাঁদবার কেঁদে নিয়েছিলো সেবারই!? আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটায় নীলয় বৃষ্টিতে ভিজতে চায়। বৃষ্টি বুঁদ হয়ে থাকত অঘোর বর্ষণের রিমঝিম শব্দে। সে ভাবত মেঘের রঙ বুঝি কালো! মেঘের সত্যিকারের রং তাকে চিনিয়েছিলো নীলয়। তার দেওয়া মেঘ রঙা চাদরটা আজো সযত্নে তুলে রেখেছে বৃষ্টি। সামান্য ঠাণ্ডা লাগলেই যেটি গায়ে জড়িয়ে উষ্ণতা খুঁজে নিত বৃষ্টি। পরম মমতায় যেন নীলয়ই তাকে আগলে ধরেছে! এতটা নিরাপদ নিজেকে কখনোই মনে হয় নি। চোখ বুঁজে নিশ্চিন্তে কল্পনার লাগাম খুলে রঙিন স্বপ্ন এঁকে যেত। স্বপ্ন দেখার পদ্ধতিটা নীলয়ের কাছেই শেখা। পৃথিবীকে জয় করার অদম্য ইচ্ছে শক্তিটাও নীলয়ের কাছ থেকেই পাওয়া। ছোট্ট শিশুরা যেমন বাবার হাত ধরে হাঁটতে শেখে। বৃষ্টি নীলয়ের হাত ধরে বাইরের পৃথিবীটাকে চিনতে শিখেছিলো ঠিক তেমনি করেই। চার দেয়ালের আবদ্ধ জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সুদূর নীলিমার নীলে হারিয়ে যেতে শিখেছিলো। নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে শিখেছিলো। একজন পরিপূর্ণ মানুষে রূপান্তরিত করেছিলো ওকে নীলয়। তাই বুঝি বৃষ্টির সবচেআপন, সবচেকাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলো একমাত্র নীলয়। একাকিত্ব ছিলো যার নিত্য সঙ্গী সেই বৃষ্টির সারাদিনমানের খবর নেবার একজন হলো! পৃথিবীটাকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম মনে হতে লাগলো। নীলয়ের সব পছন্দ -অপছন্দকে নিজের করে নিয়েছিলো বৃষ্টি। নিজেকে ঠিক সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলো যেভাবে নীলয় চেয়েছিলো। তারপরের সময়গুলো যেন খুব দ্রুত কাটতে লাগলো। একদিনের সেই ভীতু বৃষ্টিকে নীলয় এতটাই সাহস দিলো অসম্ভবকে সম্ভব করার উন্মাতাল নেশায় মাতলো বৃষ্টি।

কিন্তু হুইলচেয়ারের চাকায় গড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসার স্বপ্ন দেখে এক মেয়ে, এটা জেনে সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এও কি সম্ভব! সে তো সাধারণ মেয়ে নয়। তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থা যে তার শরীরে প্রতিবন্ধিতা নামক মোহর লাগিয়ে দিয়েছে। তার কী সাধ্যি স্বাভাবিক জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখে! ভদ্র-শিক্ষিত সেই সমাজ রুখে দাড়ালো অসম এই বিয়ের বিরুদ্ধে। অনেক বাকবিতন্ডা, দীর্ঘ যুদ্ধ। অবশেষে একদিন তাদের ভালোবাসার সামাজিক স্বীকৃতিটুকু আদায় করে ছাড়লো দুজনে। শুরু হলো নতুন সংসার নতুন কিছু স্বপ্ন বুকে নিয়ে। তাদেরচেসুখী বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ ছিলো না সেদিন। বৃষ্টির মনে হলো পুরো পৃথিবী যেন তার হাতের মুঠোয়। নীলয়ের হাতে হাত রেখে, নীলয়ের দুপায়ে হেঁটে বেড়ানোর তৃপ্তি বৃষ্টিকে অন্য এক জগতে নিয়ে এলো। তার ধারণা দিনগুলো ভালোই কাটছিলো তাদের। যুদ্ধজয়ের আনন্দে আত্মহারা বৃষ্টি টেরও পেলো না সমাজের সাথে যুদ্ধ করে করে কখন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো নীলয়। ক্রমেই দুরত্ব বাসা বাঁধতে লাগলো দুজনার মাঝে। অনতিক্রম্য দুঃস্বপ্নের মুহূর্তগুলো ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো যেন। সমাজ -সংসার সম্পর্কে অজ্ঞ বৃষ্টি বাস্তবতার কষাঘাতে নিঃশেষ হতে হতে প্রাণপণে সজোরে আকড়ে ধরতে চাইলো নীলয়কে। কিন্তু নীলয় যেন দূর থেকে দূরে - আরো দূরে... ধীরে ধীরে বিন্দুর মতো হতে হতে হুট করে একদিন সুদূরের ওই সীমানায় মিলিয়ে গেলো।

এখন আর তাদের স্বপ্নপুরীতে পাখির কলতান শুনতে পাওয়া যায় না। ঝাউগাছটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। কোথায় যে হারালো তার নীলয়! তাকে আগলে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় ব্যর্থ বৃষ্টির দৃষ্টি আকাশে মেঘেদের আড়ালে নীলয়কে খুঁজে বেড়ায়। সবুজ পাতাদের আড়ালে নীলয়কে খোঁজে। রাস্তার অগুণতি মানুষের ভিড়ে খোঁজে। দীর্ঘ দিন শেষে ক্লান্ত রাত্তিরে বিছানায় তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার মাঝেও নীলয়ের মায়াবী মুখখানা খুঁজে ফেরে বৃষ্টির করুণ চাউনি। কোথাও নেই নীলয়! আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠতে চায় বৃষ্টি। প্রাণপণে শরীরের সমস্ত শক্তি আঁকড়ে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে হয় নীলয়কে। বড্ড বলতে ইচ্ছে হয়, “শুধু একটিবার ফিরে এসো। পারছি না আমি। তোমায় ছাড়া জগৎ আমার শূন্যতায় ভরে ওঠে।কিন্তু গলা চিরে একটি শব্দও যে বেরুতে চায় না!
তারপর!!

তারপর ......... সময় যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। রিমঝিম বৃষ্টির রেশ কাটতে না কাটতেই শিমুল তুলার শুভ্রতা নিয়ে শরৎ এলো। শীতের বুড়িও একসময়ে সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে গেলো। আবার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। আবারো রিমঝিম বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। এভাবেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকা সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসে আজকের আষাঢ়ে সন্ধ্যায় বৃষ্টির উপলব্ধি শূন্যতায় আটকে গিয়েছে কি না ভেবে পায় না সে। অথচ এই তো কটা বছর আগেও আজকের এই দিনে নীলয়ের পাশে না থাকা প্রবল এক মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করাত তাকে। ভয়ংকর আক্রোশে সব চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে হতো সে সময়, হয়ত কখনোসখনো নিজেকেও... কিন্তু আজ আর তার মনে দুঃখ-কষ্ট কিম্বা আনন্দেরও কোন অনুভূতিই কাজ করে না। হয়তো প্রচণ্ড সে অভিমানে মনের ভার অশ্রু হয়ে গড়িয়ে গিয়েছে কোনো এক অচিনপুরে। যেখানে আকাশে মেঘের ভেলায় স্মৃতিরা সব ভেসে বেড়ায়। বুঝিবা দূর থেকে বলে,

মেয়ে, ভালো না থাকলেও ভালো থাকতে হয়, ভালো না থাকার এ পৃথিবীতে। যেখানে স্বপ্নের তো জায়গা আছে কিন্তু কোনো প্রত্যাশা থাকতে নেই। তাই কেবলই ভালো থাকার চেষ্টা করো। চোখ বুঁজে রোদ্দুরের পরশ নিও প্রাণভরে। দ্যাখো, আলোকিত এক পৃথিবী যে তাকিয়ে আছে তোমার পানে!   

- সাবরিনা সুলতানা