Thursday, January 21, 2016

বেদুইনদের দিনলিপি: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ (by Ummey Qulsum Nipun)

আমি ইথিওপিয়ার বর্ডার থেকে বলছি।
পাশাপাশি এই ফটোগুলা দেখলে একটু টাশকি লাগতে পারে, অবিশ্বাস্য লাগলে লাগতেও পারে, কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। কারণ সবগুলা আজকের আর কালকের তোলা। খালি একটা ১৯০৭ সালের , যখন আমি সোমালিয়াতে কাজ পেয়ে আসি নাই। মাত্র ১০০ বছর আগেও যারা আমাদের শাবানা আপা রোজিনা আপার মতো সাদা কাপড় প্যাঁচ দিয়ে পরত, কোনো জ্যাকেট- ব্লাউজ ছাড়া। তারা যে কেম্নে এখন ওই আলখাল্লা বোরখার ভিতরে ঢুকে গেল ঠিক বুঝে ওঠা দায়।
কাঁটা গাছে ছাওয়া ওই মরুভূমি মার্কা এলাকা দিয়ে যখন প্রজেক্ট ভিজিট করতে যাই, চোখ আঠার মতো জানালার কাচে লাগিয়ে রাখি যেন একটা দৃশ্যও নষ্ট না হয়, আর বুভুক্ষুর মতো গিলতে থাকি দৌড়ে পালানো উটের সারি, কিম্বা ছাগল-ভেড়ার শংকর Somali Shoats-এর পাল। বেদুইন গোত্রের এই মানুষদের কাছে যেতে চাইলে, কথা বলতে চাইলে ঠিক এভাবেই কেউ কেউ দৌড়ে পালায়, ভয়ও পায়। কে বোঝাবে ওদের যে এই ছোট্ট মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে আমি তোমাদের মারব না তো!!! পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন টুকরা কাপড় দিয়ে বানানো ওদের ছোট্ট ছাউনি ঘর, মাইলের পর মাইল কোনো জনমানব নেই, পানি নেই- শস্য নেই। পাশাপাশি ২-৪টা বা ৬টা ঘর নিয়ে হয়ত একটা গ্রাম, কেউ কেউ শুধুই একা আর তার এক পাল ভেড়া, অথবা একটা গাধা নিয়ে সংসার। বেদুইন বাড়ির (এমনকি আধুনিক সোমালি সমাজেও) মেয়েদের মূল কাজ সারাদিনের খরচের জন্য পানি সংগ্রহ করে আনা। ১৫-২০ কিলোমিটার হেঁটে, কখনও বর্ডার পার হয়ে জেরিকেন ভরে পানি তারা পিঠে করে বয়ে আনে- ওইটুকুতেই সারাদিনের খাওয়া, রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কী না করে! প্রতিদিন গোসল করা তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র, খাওয়ার পানিই তো জোটে না। সারাদিনে খাবার বলতে একটু ভুট্টা আর সাথে বুনো লতাপাতা সিদ্ধ, কালেভদ্রে ভেড়ার/খাসির মাংস। তবে ওদের অনেকেরই মোবাইল আছে। বেদুইন এই মানুষগুলোর প্রয়োজন মেটাতেই কি না কে জানে, এক ধরনের মোবাইল এখানে পাওয়া যায়, যেটা দেখতে আমাদের টিভির রিমোটের মতো, মাথায় টর্চ ওয়ালা- একবার চার্জ দিলে সাত দিন অন্তত চলে। এত বড় আর ভারী যে কথা বলতে বলতে রাগ উঠলে ওইটা ছুঁড়ে আশেপাশের কারো মাথা ফাটায়ে দেয়া যাবে। তবে সোমালিরা মোটেই রাগে না কিন্তু (থুতনি থেরাপি তো আছেই সাথে)।
মরুভূমি ধরে যেতে যেতেই চোখে পড়বে ঝকঝকে সবুজ গাছের সারি। গাড়ির দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেলে, তখন হঠাৎ করে চোখ খুললে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে "আরি, বাংলাদেশ এলাম কখন?"... হতভম্ব মুরগির মতো বারবার এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়- উপত্যকা খুঁজে না পেলেও সমস্যা নেই, একটু পরেই উট এসে জানালার কাচে নাক ঘষতে পারে (খুব সৌভাগ্যবান হলে)। আজকে এই উটগুলোর মালিক ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে আমাকে। :( :(
ফটো তুলতে গেছিলাম যে! ওদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা আছে যে ছবি তুললে ওর পশুগুলো মরে যাবে।
এখানেই শেষ না। গাছের সারিগুলোর বেশিরভাগ জোড়া জোড়া করে লাগানো। সোমালিরা বিশ্বাস করে "বিয়ের পর জামাই- বউ একসাথে গাছ লাগালে সেই গাছ যতদিন বাঁচবে, ততদিন ওরাও একসাথে থাকবে"। গাছগুলোর গায়ে নাম লেখার ব্যবস্থা থাকলে সোমালি পলিগ্যামিস্টদের খবর ছিল। দেখা যাইত বড় বউ এসে ছোট বউয়ের নামে লাগানো গাছ কেটে দিয়ে গেছে। :P :P

কালকে শহর থেকে অনেক দূরে দেশটার শেষ মাথায় যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই গাড়ির চাকা খুলে দৌড় দিলো। তিন চাকায় ঘ্যাস ঘ্যাস করে আমরা চলতে থাকলাম, আর বেকুবের মতো তাকায়ে তাকায়ে দেখতে থাকলাম চাকা বাবাজি নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে মরুভূমির ভিতর দিয়ে, কোথায় কে জানে! প্রায় আধ মাইল গিয়ে তারে খুঁজে পাওয়া গেছে !!! সিনেমাতে বহুবার দেখা এই সিন যে আমার জীবনেও ঘটবে, স্বপ্নেও ভাবিনি কোনদিন। সেই সুখে রাস্তা উপরেই মডেলিং করতে বসে গেছিলাম, আবার নতুন করে চলা শুরু করার আগে।
টম হ্যাংকস তো বলেই দিছে,
‘Life was like a box of chocolates. You never know what you’re gonna get.’

এই পিচ্চিগুলাকে হাসাইতে আমার জান বের হয়ে গেছে- ওরা মাঠে ছাগল চড়ায়। মিস গোলাপি অবশ্য ম্যানচেস্টারে থাকে- মহা পাকনা। ৩ বছর বয়সি এই ভদ্রমহিলার ফিলসফি হলো "বিয়ে করবা না কিন্তু, খবরদার!" আমার মাথার কাপড় পড়ে গেলেই সে চোখ রাঙায়ে সেটা ঠিক করে দিচ্ছিল।


সোমালিল্যান্ডের বেদুইন আবাস... ওদের আধুনিক গালভরা নাম হলো Nomads, Pastoralists, Agro-pastoralists.
  
ইয়াপ... বাংলাদেশ না