Monday, March 18, 2013

সময় টিভিতে নারীদের ছদ্মনামে ব্লগিং বিষয়ে আলাপ

সময় টিভিতে বৃহস্পতিবার রাত ৮:৩০-এ "অনন্যা" নামে একটা নারীবিষয়ক অনুষ্ঠান হয়। গত ১৪ই ফেব্রুয়ারির পর্বের বিষয় ছিলো "কথার স্বাধীনতা"।
এই পর্বের একটা অংশের জন্য তারা এমন কোনো নারীকে খুঁজছিলেন যিনি ছদ্মনামে ব্লগিং করেন। ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট সাবরিনা সুলতানার মাধ্যমে আমার খোঁজ পেয়ে তারা যোগাযোগ করেন। মেয়েরা কেন ছদ্মনামে ব্লগিং করছেন সেটা নিয়ে আলাপ করা দরকার ভেবেই আমি সম্মতি জানাই।
১০ ফেব্রুয়ারি, রবিবার সন্ধ্যায় "অনন্যা"র পক্ষ থেকে অতি চমৎকার দুজন মানুষ আমার বাসায় এসে সাক্ষাৎকারটুকু ধারণ করেন। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর পাঁচটি প্রশ্ন দেওয়া হয় আমাকে। প্রচারিত অনুষ্ঠানে আমার প্রশ্নোত্তরের পুরোটা দেখানো হয়নি। তাই কিছু বন্ধু বললো অপ্রচারিত অংশসহ সাক্ষাৎকার লিখে রাখতে যাতে ব্যাপারটা নিয়ে সবাই আলাপ করতে পারে। প্রশ্নপত্রটি আমি রেখে দিইনি। আর উত্তরগুলোও সব মনে নেই। যেটুকু মনে আছে সেটুকু তুলে দিচ্ছি। ভিডিওতে যেটুকু দেখানো হয়েছে সেটুকু শুনে শুনে লিখলাম। পড়ার সুবিধার্থে এবং, আসলে, তো ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় শব্দ বাদ দিয়েছি।

১) ব্লগিং কেন করেন? কবে থেকে করছেন?
৩ বছর আগে যখন ব্লগিং শুরু করি তখন ব্লগ সম্পর্কে ধারণা ছিলো না কোনো। আমি ছোটবেলা থেকেই লিখতাম। প্রিন্ট মিডিয়াতে লিখতাম। আমার লেখা বিভিন্ন পত্রিকাতে ছাপা হতো। এরপরে আমি এমন একটা জায়গায় পড়ালেখা করতে গেলাম যেখানে আসলে সৃজনশীল লেখালেখির সুযোগ কম। এবং সেখান থেকেই বিভিন্ন কারণে লেখায় একটা বিরতি হয়। এরপর ফেসবুক এলো। ২০০৭ থেকে আমরা ফেসবুকিং শুরু করি। ফেসবুকে নোট লেখা যায়। আমার যা ভাবনা ওই সময় আমি নোট লিখে প্রকাশ করতে শুরু করি। সেটা শুধুমাত্র আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। যারা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলো তারা দেখতে পেত এবং উৎসাহ দিত। সেখান থেকেই কোনো কোনো বন্ধু আমাকে বলত আমি ব্লগে কেন লিখছি না। ব্লগ বলতে যে কিছু একটা আছে, ওইসময়ই আমি জানতে পারি। বন্ধুদের লিংক শেয়ার করার মাধ্যমে দেখতে পেতাম ওরা ব্লগে কিছু একটা পড়ছে। একটা জায়গা আছে যেখানে লেখালেখি করা যায়। এভাবে ব্লগের সাথে পরিচয় হয়। যেহেতু লেখার ইচ্ছেটা আমার সবসময়ই ছিলো, এবং আমরা অনলাইনে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম, আর ব্লগ হচ্ছে অনলাইনে লেখালেখির জায়গা, তো ওইসময় লেখার ইচ্ছে থেকেই, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার ইচ্ছা এবং আমার ভেতরে যে প্রবণতা আছে লেখা দিয়ে নিজের ভাব প্রকাশ করার ওই স্রোতেই আমি ব্লগে চলে আসি।

২) নিজের ভাবনা প্রকাশ করার জন্য ব্লগিং করছেন। তাহলে ছদ্মনামে কেন?
অনেক নারীই ছদ্মনামে ব্লগিং করেন। সবার কারণ নিশ্চয়ই এক না। আমি কেন ছদ্মনামে লেখা শুরু করলাম সেটা বলার থেকে বরং ছদ্মনাম হিসেবে ওই নামটাই কেন বেছে নিলাম সেটা বললে আমার ব্যক্তিগত অবস্থানটা বোঝানো যাবে। এক কথায় কারণটা হলো- লিঙ্গবৈষম্য এড়ানো।
ব্লগের সাথে পরিচিত হওয়ার আগে এক সময় আমরা অনলাইন চ্যাট করতাম। আমি দেখতাম আমার নামে যে অ্যাকাউন্টটা সেটা দিয়ে যখন লগিন করছি, একটা রুমে ঢোকামাত্র চারদিক থেকে অনেক ছেলে নক করা শুরু করল। তারা সবাই আমার সাথে পরিচিত হতে চায়। ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়। আমি বলব না তাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সাড়া অপ্রত্যাশিত রকমের বেশি আসত। এরপর আমি দেখলাম আমি যদি এমন কোনো নামে যাই, যে নাম দিয়ে বোঝা যায় না আমি ছেলে নাকি মেয়ে, সেক্ষেত্রে কিন্তু সাড়া একদমই পাওয়া যায় না। বোঝা যাচ্ছে যে একটা লৈঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা আমার সাথে আলাপ করতে আগ্রহী হচ্ছিলো যেটা আমি চাচ্ছিলাম না। আমি গঠনমূলক আলাপ চাচ্ছিলাম। মেয়ে হিসেবে সেটা আমি পাচ্ছিলাম না। বরং অপ্রত্যাশিত কিছু প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। ব্লগে সেটা চাই না বলেই আমি এমন একটা নাম বেছে নিই যেটা লিঙ্গনিরপেক্ষ। আমাদের সমাজে শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে একজন মানুষের প্রতি নানারকম পক্ষপাতিত্বপূর্ণ এবং বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। কোনো পুরুষ কবিতা লিখলে তিনি কবি। কিন্তু নারী কবিতা লিখলে মহিলা কবি হিসেবে অভিহিত হবেন। কোনো লেখার শিরোনামের নিচে যেখানে লেখকের নাম লেখা থাকে, সেখানে কোনো নারীর নাম দেখলে অনেকেই বলেন, "ওহ! মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ কী আর লিখবে।" লেখাটা পড়ার পরে যদি ভালো লাগে তখন তারা বলবেন, "মেয়েদের তুলনায় ভালোই লিখেছে।" আমার খুব প্রিয় একজন লেখন যিনি একজন নারী, তার সম্পর্কে আমি বলতে শুনেছি, "মেয়েদের মধ্যে ওর লেখাই আমার ভালো লাগে।" মন্তব্যকারী ধরেই নিয়েছেন যে একজন নারীর লেখা একজন পুরুষের তুলনায় দুর্বল হবে। তাই তিনি নারীর জন্য একটা আলাদা মানদণ্ড তৈরি করে নিয়েছেন। তিনি কোনো পুরুষ লেখকের সাথে তার তুলনা করছেন না। তুলনা করছেন অন্য নারী লেখকদের সাথে। এ কারণেই আমি পুরুষ নই এটা আবিষ্কার করে অনেকেই অবাক হন। ছদ্মনামের আড়ালের মানুষটা যে আমি, সেটা জানার পর তারা বলেন, "সে কী? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ছেলে।" এই মন্তব্য কিন্তু একই সাথে প্রশংসাসূচক এবং অবমাননাকর। আমি মনে করি না লেখা দিয়ে কারো লিঙ্গ সনাক্ত করা সম্ভব। আমার লেখা আমার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। আমার লৈঙ্গিক পরিচয় সেই প্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াক সেটা চাইনি বলেই এমন একটা নাম বেছে নিয়েছি যেটা পাঠকের কল্পনায় কোনো নারীর অবয়ব তুলে ধরে না, এবং পাঠকের একটা নিরপেক্ষ মতপ্রকাশের সুযোগ দেয়। ছদ্মনামে লেখার ব্যাপারটা সে অর্থে একটা পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা বলতে পারেন। 
সে সময় আমি চাচ্ছিলাম না যে প্রথম দর্শনেই একজন ভেবে বসে যে এটা একটা মেয়ে। এর লেখার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকবে। হয়ত হালকা ধরনের কিছু লিখবে যাতে কোনো গভীরতা থাকবে না। একদম প্রথম পর্যায়ে ওই বাধাটা অতিক্রম করতে এই নামটা সাহায্য করেছে। এরপরে ব্যক্তি আমাকে যখন মানুষজন চিনেছে, যখন তারা জেনেছে এই নিকের আড়ালে এই মেয়েটা আছে, তখন কিন্তু আমাকে সেরকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ ততদিনে তারা আমার ভাবনার সাথে পরিচিত। 

৩) ব্লগিং করতে গিয়ে পারিবারিক কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
আমাদের পরিবারে লেখালেখির চল আছে। খুব ছোটবেলায় যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন থেকে পারিবারির সমর্থন পেয়েছি। ইন্টারনেট বা ব্লগিং সম্পর্কে আমাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্মের মানুষজন বেশিরভাগই তেমন কিছু জানেন না। আমার মা-বাবাও বিশদ কিছু জানতেন না। কিন্তু কোথাও লেখালেখি করছি, একটা সৃজনশীল পরিমণ্ডলে আছি এটা তারা বুঝতেন। সে কারণে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিলো। কোনোরকম বাধা কখনোই ছিলো না।

৪) যে স্বপ্ন নিয়ে ব্লগিংয়ে এসেছিলেন সে স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে?
আগেই বলেছি ব্লগিং সম্পর্কে কোনো ধারণা ছাড়াই ব্লগে এসেছি। তাই কোনো স্বপ্ন নিয়ে শুরু করিনি। যে ব্লগে আমি যুক্ত, সেটাকে একটা লেখক তৈরির কারখানা বলা যেতে পারে। এখানে একজন ব্লগার লেখার চর্চা আর পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজের লেখনিশক্তিকে শানিত করতে পারেন। লেখক হিসেবে নিজের সাধ্যমতো উৎকর্ষ অর্জন করতে পারেন। ব্লগের এই শক্তির পরিচয় পেয়ে নিজের লেখনিশক্তির সর্বোচ্চ স্ফূরণ আমিও দেখতে চেয়েছি। স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। গত প্রায় দুবছর ধরে ব্লগে আমি অনিয়মিত। বলতে পারেন স্বপ্ন পূরণের পথে আমি নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি।

৫) নারী ব্লগার হিসেবে কোনো ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন? সেগুলো দূর করার উপায় কী বলে মনে করেন?
আমি যেহেতু একটা লিঙ্গনিরপেক্ষ ছদ্মনামে ব্লগিং করি, সেহেতু নারী ব্লগার হিসেবে তেমন কোনো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইনি। তবে কোনো কোনো ব্লগে, ফেসবুক বা অন্য যেকোনো অনলাইন মিডিয়ায় নারী হওয়ার কারণে একজন মানুষকে কিছু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় এটা সত্যি। কোনো নারীর বক্তব্য মনঃপুত না হলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। তার নামে কুৎসা রটানো হয়। এটা আমাদের অফলাইন আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। বাস্তব জীবনে আমাদের সমাজে কোনো মেয়েকে দমিয়ে দেওয়ার মুখ্য হাতিয়ার হলো তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তাকে শারীরিক, মানসিকভাবে আঘাত করা যাতে সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। ব্লগ, ফেসবুক এগুলো তো বাস্তব জীবনেরই একটা বিমূর্ত অংশ। বাস্তব জীবনে যেভাবে নারীকে শারীরিক বা মৌখিক আঘাত করা হয়, অনলাইনে সেটা করা হয় লিখিত অক্ষর দিয়ে।

এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। সচেতনতার প্রয়োজন। নারী-পুরুষ সবারই। মেয়েরা যত বেশি হাত খুলে, মন খুলে লিখবেন এবং পুরুষেরা তাতে যত বেশি অভ্যস্ত হবেন, নারী বা পুরুষ হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে, পাঠক হিসেবে যত মন খুলে সেটা গ্রহণ করবেন ততই ভাবনার ব্যবধান কমে আসবে। বাস্তব জীবনে ভাবনায়, আচরণে পরিবর্তন না এলে অনলাইনে শুধরানো সম্ভব না।

পরিশিষ্ট:
আমার পরিচয়ে বলা হয়- 
তৃষিয়া নাস্তারিন একজন ব্লগার। চেয়েছিলেন লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরবেন। পাশাপাশি সবরকম অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে তার লেখনি দিয়ে রুখে দাঁড়াবেন।

আমার দুর্বোধ্য নাম নিয়ে বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা আজন্ম। তাই পইপই করে বলে (এবং লিখে) দিয়েছিলাম নাম। ভুল নাম শুনে স্বভাবতই বিরক্ত হয়েছি। ব্লগে কেন লিখি তার উত্তর উপরে দেওয়া আছে। লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা বা অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে লেখনি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কিছু বলেছিলাম বলেও মনে পড়ছে না।

ভিডিওগ্রাফি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই। তাও আমার মনে হয়েছে কিছু অপ্রীতিকর অ্যাঙ্গেল এড়ানো যেত। ঢাকায় ফিরেছিলাম সেদিন বিকেলেই। খুব ক্লান্ত ছিলাম। সাজগোজের ধৈর্য বা শক্তি কোনোটাই ছিলো না। নিজের চেহারা দেখানোর গরজও ছিলো না। আমার চেহারা যেহেতু এখানে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়, সেহেতু আমার চেহারা ব্লার করে দিতে বলেছিলাম। বলা হয়েছিলো কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে আমাকে জানানো হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে পরবর্তীতে আমার সাথে আর কোনো আলাপ করা হয়নি।