Wednesday, October 30, 2013

একজন মানুষের গল্প

আমার বিয়ে ভেঙেছে অনেকদিন হলো, কাগজে কলমে যদিও বছরখানেক মাত্র। বিয়ে ভাঙার কারণ অনেকে জানতে চায়, বেশিরভাগকেই যেইটা বোঝাতে পারি না সেই কথাটা মনে হয় এখানে অনেকে বুঝবেন। ছোটবেলা থেকে নিজেকে আলাদা করে মেয়ে হিসেবে কখনো দেখিনি, বিয়ের পরে সেই কথাটা রোজ মনে পড়ে যেত, আর দম বন্ধ হয়ে আসত। আমার যে পার্টনার ছিলো মানুষ হিসেবে সে নেহায়েতই ভালো মানুষ ছিলো, কিন্তু ভুল ছিলো একে অন্যকে বোঝায়। আমার ভালোবাসার মানুষের জন্যে আমি অনেকদূর যেতে পারি, এটুকু দেখে সে ভেবে নিয়েছিলো নিজেকেও পালটে একটা মেয়েমাত্র বানিয়ে নেবো। যেহেতু সমাজ বলেছে, তাই আমি মেয়ে বলে আমাকেই বাবা মা ছেড়ে যেতে হবে, আমার পার্টনারকে তার বাবার বাড়ি ছাড়তে বললে আমি মহা শয়তান আর পাজি মেয়ে, আর আমাকে যে ছাড়তে হলো বাবামা-ভাইবোন, সেইটা শুধু সমাজস্বীকৃত বলে ঠিক জিনিস এইরকম হিপোক্রিসি আমি নিতে পারতাম না। শ্বশুরবাড়িতে চুপচাপ থাকতাম কারণ আমি কথা বলিও কম, আর যা কথা বলার মতো সেইটা সমমনাদের সাথে হয়, অন্যদের সাথে বেয়াদবি না করে চুপ থাকলেও সমস্যা। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার কদাচ করি না, কিন্তু খামোখাই গায়ে পড়ে যেই ভালোবাসা নাই সেইটা দেখাতেও যাই নাই। খালি বিয়ে হয়েছে বলেই তো জোর করে নতুন কিছু মানুষকে দুইদিনে ভালোবেসে ফেলা যায় না, সেইটা সময়ের ব্যাপার, ইন্টার‍্যাকশান বাড়তে বাড়তে হয়। সেই সময় পাওয়ার আগেই শীতল মানুষের মর্যাদা পেয়ে ফেলেছিলাম, সেইসাথে আমার গল্পের বই পড়ার আগ্রহ আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর চাকরির বদৌলতে অহংকারী খেতাবও। রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করেও ঘরে কাজের লোক রাখার অনুমতি পাইনি, যদিও তখন আমার নিজেরই অন্তত পাঁচটে কাজের লোক রাখার ক্ষমতা আছে। আর ক্লান্ত শরীরে ঘর গোছানো হয়নি বলে রোজ খোঁটা, বাবার অর্থনৈতিক স্ট্যাটাসের বলে পরোক্ষে নবাবজাদী খোঁটাও শুনেছি।

আমার এক্সপেকটেশানে ভুল ছিলো পার্টনারকে নিয়ে, ভেবেছিলেম এত প্রগতিশীল মানুষটা বুঝি আমাকে আমি হিসেবেই বেছে নিয়েছিলো। ভুলটা দুই তরফেই, সে ভেবেছিলো আমি ঘরোয়া হবো, আমি ভেবেছিলাম সে আমার জন্যে সব করতে পারে। আমি যে তার জন্যে আমার পরিবার ছেড়েছি সেইটা সামাজিক প্রথা, আর সে জানান দিত সে আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসত, অথচ আমাকে নিজের একটা ঘর দেওয়ার সামর্থ্য ছিলো না তার। রান্নাবান্নার কি ভীষণ শখ আমার ছিলো, অথচ নিজের একটা কিচেন পর্যন্ত ছিলো না। এইটা স্বাভাবিক মনে করতে পারিনি আমি। আর শ্বশুরবাড়িতে গাদাগাদা লোকের ভিড়ে, পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার মতো মানুষদের চোখের সামনে নার্ভাস হয়ে রান্না করাটা আমার কাছে কখনোই আনন্দদায়ক মনে হয়নি। তাও আবার কিছু রান্না করতে হলেই সেইটা কমপক্ষে বিশ জনের জন্য করতে হতো। শখের কিছু রান্না করলেও সেইটা অপচয়। আমার আলাদা করে শ্বশুরবাড়ির কাউকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নাই, কারণ তারা আসলে খুবই টিপিক্যাল অর্খে যা যেভাবে হয়ে আসছে সেইটাই এক্সপেক্ট করে আসছে, কিন্তু যা হয়ে আসছে তাই যে একমাত্র সঠিক বস্তু না, সেইটা কি কেউ টের পায় না? বউ মাত্রেই সুশীল, সুন্দরী, সেবাদানকারী মেশিন না এইটাও কি কেউ ভাবে না?

যাই হোক বিয়ে ভাঙার পরে আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের আহাউহুতে মনে হয়েছিলো কয়দিন আমার জীবন মনে হয় এইখানেই শেষ। বিরক্ত হয়ে বেশিরভাগ গ্যাদারিংয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার তো নিজেকে কষ্টে থাকা বেচারী মনে হয় না। আবার বিয়ের কথা শুনলে বরং বিরক্ত লাগে। কখনো ইচ্ছে হলে করবো, বাবা-মা-কে এতোদূর বলেছি। ভাগ্যিস আমার বাবা-মা এইটা নিয়ে ত্যানা প্যাঁচায় না। ডিভোর্সী বলে বাসায় কখনো কোনো ছেলে বন্ধু বা আত্মীয় এলে বাড়িওয়ালী সেইটা রিচেক করতে আসে। বাংলাদেশের মানুষ কেন জানি এখনও এক ঘরে ছেলে মেয়ে থাকা মানেই আগুন-ঘি পাশে থাকার মতো ভালগার ধারণা নিয়ে বসে আছে। প্রথমত দুইজন অ্যাডাল্ট কমিটেড বা নন-কমিটেড মানুষ কী করবে সেইটা তাদের ব্যাপার। আর ছেলেমেয়ে একসাথে থাকলেই তারা কেবল ফিজিক্যাল কোনো সম্পর্কে যাবে এর চেয়ে অখাদ্য ধারণা আর নাই। অসলোতে আর লন্ডনে থাকাকালীন কাজের জন্য, পড়ার জন্যে কতবার ছেলে বন্ধুদের বাসায় স্টে ওভার করেছি। সেইসব বন্ধুরাও কোনদিন বন্ধুত্বের সীমানা মাড়ায় নি, আর অন্য কারো গায়েও লাগেনি।

দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু যখন বিলাতের বা নরওয়ের দিনগুলা মনে পড়ে যখন আমি দিনে-দুপুরে-রাতে-বিরাতে ঘুরতে যেতাম, নিজের মতো করে নিজের ঘরে থাকতাম, সেই স্বাধীনতার জন্যে আবারো চলে যেতে ইচ্ছে করে। আমার এমনিতে পশ্চিমা বিলাস নাই, খালি নিজের জন্য বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আছে। জীবন নিয়ে আলাদা কোনো অভিযোগও নাই, খালি যখন মনে হয় নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, একমাত্র তখন অসহায় লাগে। ফেসবুকে, অনলাইনে নানারকম মানুষের মেয়ে সংক্রান্ত মতামত দেখে মাঝে মাঝে টের পাই যতই মানুষ হয়ে উঠতে চাই না কেন, এই মেয়ে হয়ে থাকার ট্যাগটা অনেক সহজে যাবে না বোধহয়। এই মানুষগুলা নিজেদের অসুস্থতা আর অসংগতি কেন টের পায় না?

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১ (by Maksuda Aziz)


1      বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যা সব ক্ষেত্রে পিছনের দিক দিয়ে ১ম দশটি দেশের তালিকায় থাকে। ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ কখনও যদি বাংলাদেশ শুরুতে অবস্থান করে তবে সেটা অবশ্যই আশংকাজনক কিছু হয়। Millennium Development Goals (MDGs) এ ২টা ক্ষেত্রে নারীকে লক্ষ্য করে নেয়া হয়েছে। MDG-3: Promoting gender equality and empowering women এবং MDG-5: Improving maternal health.

মনে রাখবেন এই নীতি জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশকে লক্ষ্য করেই নেয়া হয়েছে, এবং ভাববার বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশেও নারী খুব ভাল অবস্থানে নেই। সবখানেই নারীকে পিছন থেকে ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন হিলারি ক্লিন্টন। তিনি তার আত্মজীবনী Living History তে লিখেছেন,
Too many women
in too many countries
speak the same language,
of silence...


আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশ নামক দেশটি MDG পূরণে অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এখানে সরকার এবং জনগন উভয়ই নারীর ক্ষমতায়ন ব্যাপারটাইয় যথেষ্ট উদার। আমার মতে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি তারই একটি প্রমাণ। এখানে আমি যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই নারীনীতি প্রকাশ পাবার পরি তা নানা ভাবে misinterpreted হয়েছে। একটি মাত্র ধারা যেখানে বলা ছিলঃ
 এ ধারাটি অনেকে নিজেদের মত ব্যাখ্যা করেন এবং সাধারণ জনগনকে এমন একটি ধারণা দেন যে নারীকে ইসলামিক শরিয়া আইন ভংগ করে পুরুষের অর্ধেক সম্পদের ভাগ দেয়া না হয়ে পুরুষের সমান ভাগ দেয়া হবে যেখানে থেকে আসলে সকল সমস্যার শুরু হয়।

আইনের ভাষা সাধারনত সকলের বোধগাম্য হয় না ফলে অপব্যাখ্যা করা খুব সোজা। উপরের ২৫।২ ধারাটি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় একটি মেয়ে তার উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ ইত্যাদি যে কোন ক্ষেত্র থেকে যতটুকু অর্থই অর্জন করে থাকুক না কেন তার নিয়ন্ত্রন আইনের মাধ্যমে তার নিজের কাছে থাকবে
ব্যাপারটা আরও খোলাসা করে ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায় যে, ধরুন আপনি বাবার বাড়ি থেকে ভাইয়ের অর্ধেক সম্পদ (শরিয়া মোতাবেক) পেয়েছেন এই সম্পদে খচর, বিনিয়োগ, দান ইত্যাদির অধিকার পুরাই আপনার। আপনি আপনার টাকা আপনার হাতে থাকবে আপনার ভাই বা স্বামীর হাতে নয় এবং সে টাকা আপনি কী করবেন সেই সিদ্ধান্তও আপনার আপনার ভাই স্বামী বা পুত্রের নয়।
এখন প্রশ্ন হল আপনার টাকার নিয়ন্ত্রন তো আপনিই করবেন এটা আবার আইনে বলার কী আছে? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই আছে কারণ  বাংলাদেশে কয়জন মেয়ে বাবার বাড়ির অর্ধেক সম্পত্তি সত্যিকারী অর্থে ভাইদের হাত থেকে নিজের হাতে আনতে পারে আর আনলেও তা কয়জন নিজে খরচের অধিকার রাখে? একই কথা দেনমোহরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেনমোহর আপনার অধিকার। কয়জন মেয়ে দেন মোহরের অর্থ হাতে পায়? পেলেও সেটা গহনা হিসাবে পায় এবং সেটার নিয়ন্ত্রনও থাকে অন্যের হাতে
এমন অবস্থায় যেখানে উত্তরাধিকারই ঠিক মত হাতে আসে না সেখানে উপার্জন, ঋণ ইত্যাদির নিয়ন্ত্রন পাবার প্রশ্নই আসে না। নারী শুধুই একটা কাঠের পুতুল হয়ে থাকে।

আগেই সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করে ফেললাম এখন আসুন আগে এই নীতির লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে জানিঃ
1.     বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
2.     রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
3.    নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও আইনগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।
4.     নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
5.    আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল ধারায় নারীর পূর্ণ ও সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
6.    নারীকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলা।
7.     নারী সমাজকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
8.    নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা।
9.    সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা।
10.  নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন দূর করা।
11.   নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা।
12.   রাজনীতি, প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া এবং পারিবারিক জীবনের সর্বত্র নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
13.  নারীর স্বার্থের অনুকূল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আমদানী করা এবং নারীর স্বার্থ বিরোধী প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
14.   নারীর সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা।
15.  নারীর জন্য উপযুক্ত আশ্রয় এবং গৃহায়ন ব্যবস্থায় নারীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা।
16.   প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সশস্ত্র সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
17.   প্রতিবন্ধী নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নারীর অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা।
18.  বিধবা, বয়স্ক, অভিভাবকহীন, স্বামী পরিত্যাক্তা, অবিবাহিত ও সন্তানহীন নারীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
19.  গণ মাধ্যমে নারী ও কন্যা শিশুর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা সহ জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত করা।
20.   মেধাবী ও প্রতিভাময়ী নারীর সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করা।
21.  নারী উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়ক সেবা প্রদান করা।
22.  নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা।

(June 20, 2013)