Thursday, December 11, 2014

আমার দেশের বাইরে আসা (by মুক্ত পাখি)

যখন আমি স্কলারশিপ পেলাম, তখন সবার আগে মনে হয়েছিল আমার এই অর্জনকে কে কীভাবে দেখবে। আমি এমন একটা পরিবারে মানুষ যেখানে মেয়েদের কে একমাত্র গুরুত্ব দেয়া হতো সে কতটুকু সুন্দর সেটা দেখে। কেন আমি এত খাটো, কেন আমি এত মোটা তাই নিয়ে আম্মা সারাদিন বকত। কাজিনদের (সমাজের কাছে তারা সুন্দর কারণ তারা লম্বা আর ফর্সা) সাথে তুলনা দিত। আমার সমসায়িক ছিল আমার এক খালাত ভাই। সারাদিন তার জ্ঞানের উদাহরণ দিত। যদিও সে ক্লাস এর মাঝের দিকের ছাত্র ছিল, তুলনামুলকভাবে স্কুলে আমার পজিশন ভালো ছিল, তাও আমি শুনতাম তার মতো ব্রিলিয়ান্ট নাকি জগতে নাই, ক্লাসের ফার্স্ট বয় নাকি তার কাছে থেকে পড়া বুঝে। তাকে নিয়ে আমার মা বাবার গল্পের শেষ নেই, মাঝে মাঝে মনে হতো আমি কি আদৌ আছি কোথাও? আত্মীয়স্বজনরাও একই কাজ করত। এস এস সি, এইচ এস সি দুটোতেই জি পি এ ৫ পেয়ে আমি বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ভাইটি তেমন কোন ভালো জায়গাতে চান্স পেল না। যেসব যায়গা তে সে চান্স পাবে বলে আমার মা-বাবাসহ সবাই গ্যারান্টি দিয়ে রেখেছিল আমাকে খোঁটা দিত: "তুই তো বাপের টাকা নষ্ট করবি, গিয়ে ভর্তি হবি প্রাইভেটে।" এদের সবাইকে দুঃখ দিয়ে আমি টিকে গেলাম সব জায়গায়। সবচেয়ে আজব ব্যাপার আমার মা-বাবাই মনে হয় বেশি দুঃখ পেল। আত্মীয়দের কথা বাদ দেই, আমার মা-বাবাই দেখি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে আমার তো মাথায় বুদ্ধি নাই, তাই সারাদিন মুখস্থ করি আর তাই সব জায়গাতে চান্স পেয়েছি। আমার কাজিন অনেক ব্রিলিয়ান্ট, খালি মুখস্থবিদ্যা নাই দেখে চান্স পায় নাই। কী আর বলব!
এরপরে এলো সবচেয়ে অদ্ভুত থিওরি। আমার আত্মীয়রা নাকি খুবই নিশ্চিন্ত আমি ভালো জায়গায়ে ভর্তি হওয়ায়, কারণ এতে আমার ভালো বিয়ে হবে (ভালো ইউনিভারসিটির নাম দেখিয়ে!!!)। বাকিদের তো চিন্তা নাই, কারণ তারা দেখতে সুন্দর!
পাস করে বের হয়ে আমি রিসার্চ আসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমার ইউনিভারসিটিতেই একটা কাজ শুরু করলাম। বুঝতেই পারছেন মাইনে তেমন না। ভাই এর মধ্যে ঢুকে গেছে ব্যাংকে। শুরু হলো আবার সবাই মিলে, কী হলো এত ভালো জায়গায় পড়ে? কয় টাকা মাইনে পাও? ও জানো ৬০ হাজার মাসে পায়। শুরুতেই এত পায়, বুঝো পরে কত পাবে। তুমি কী করলা? ব্রেইন না থাকলে তো এমনই হবে! আজও বুঝলাম না আমি কত পাই এইটা কেন আমার সবাইকে জানাতে হবে। আর আমার রিসার্চ করতে ভালো লাগে করলাম, তার ব্যাংক ভাল লাগে সে করবে, এখানে তুলনার কী হলো? খালা, আম্মা এবং অন্যান্যরা দেখি বিয়েবাড়িতেও ছেলের স্যালারির ব্রান্ডিংয়ে ব্যস্ত। আমার যে কী লজ্জা লাগত! মানুষজন না জানি কী ছোটলোক ভাবছে আমাদের! আর আমার মায়ের সে কী রাগ আমার উপর! আমি কেন ভালো কাপড়চোপড় পরে, সেজেগুজে কোথাও যাই না, কোনো বিয়ের প্রপোজাল আসে না, তার আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। আত্মীয়রা খালি গল্প করে তাদের স্কুলে পরা মেয়েরও নাকি বিয়ের প্রপোজাল আসে, তারা এতই সুন্দর। আম্মার খুব নিজেকে ছোট মনে হয় কারণ সে এইসব গল্প কাউকে করতে পারে না। কারণ আমাকে কারো বাসায় বা বিয়েবাড়িতে দেখেও কোনো বিয়ের প্রপোজাল আসে না। আমি খুব ক্যাজুয়াল থাকি দেখে সে নাকি সবার কাছে ছোট হয়!
এরপরে রিসার্চার হিসেবেই একটা অনেক বিখ্যাত সংস্থায় চাকরি নেই। বলাবাহুল্য আমার আম্মাই কনফিউজড আমি কীভাবে এই জব পেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল কত বেতন? বলি নাই, কারণ আমি চাই না এটা নিয়ে একটা তুলনা হোক। অনেক রাগ করেছে আম্মা আব্বা দুজনই আমার উপর। কারণ তাদের আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করছে তারা বলতে পারে নাই দেখে তাদের নাকি বলছে যে দেখ কেরানির চাকরি পাইছে (আমি যা খুশি করি তোদের তাতে কী, কোন জবটা ভালো এটা কি তোরা বিচার করবি?) । তারপরেও আব্বা আম্মা আমার উপরে রাগ। বললাম এই সব আত্মীয়দের সাথে মেশার দরকার কী? শুনতে পেলাম তুমি আসামাজিক হতে পারো কিন্তু আমাদের আত্মীয়স্বজন লাগে। সমাজে চলতে গেলে এদের কথা শুনে চলতে হয়। খুব ইচ্ছা করছিল জিজ্ঞেস করতে যে খালি তো দেখি তোমরাই কথা শুনো কিন্তু এরা কবে কী শুনছে তোমাদের? সেদিন বলি নাই, পরে বলছিলাম কি না মনে নাই, কারণ এই জবটার পরে থেকে বাসায় আমার প্রায়ই ঝগড়া হতো। তাদের নাকি আমার বিয়ের প্রপোজাল আসে না, আমি স্যালালির কথা বাসায় শেয়ার করি না, জব করে করে মেয়ের চেহারা আর খারাপ হয়ে গেছে (জব ছেড়ে বাসায় বসে রূপচর্চা করলেও তো বিয়ের প্রপোজাল আসার চান্স থাকে) এই সব শুনতে হয় আর তাই আমার উচিত এখন সবার আগে বিয়ে করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাবা মা তাদের কথার প্রতিবাদ না করে আমার উপর এসে উলটা মানসিক চাপ দিত।
এরপরেও দেশের বাইরে অ্যাপ্লাই করে গেছি বারবার। অন্তত ২০-২২ বার অ্যাপ্লাই করেছি এই ৪ বছরে। ৪ বছর পরে কোথাও একটা ভালো ফান্ডিং প্যাকেজ পেলাম। আম্মা ২ বছর আগে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিল যে আমি খালি টাকা নষ্ট করছি অ্যাপ্লাই করে। মাথায় ঘিলু নাই, এইটা বাংলাদেশে। কেউ না বুঝলেও বিদেশি তো আর বলদ না। আমার কিছুই কখনও হবে না। স্কলারশিপের খবরটা পেয়ে কোনো রিঅ্যাকশন বা তেমন কিছু দেখি নাই। কিছুদিন পরে খবর আনলেন আমার এক নিকট আত্মীয় তাকে জানিয়েছে যে কানাডা হলেও আমার ইউনিভারসিটির সিরিয়াল (ranking) অনেক পরে। মনে হল আম্মা আব্বা কিছুটা হলেও শান্তি পেল, আমি আমার খালাত ভাইয়ের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে গেলে যে আত্মীয়রা তাদের কথা শুনাবে আর তারা লজ্জা পাবে, ছোটো হবে।
আমরা অনেকেই হয়ত এই সব নেগেটিভিটির মধ্যে বড় হয়েছি। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। মাঝেমাঝেই মনে হয় অসহ্য, সব ছেড়ে দেই। কিন্তু ছেড়ে দিলে আর নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবেন না। আত্মসম্মানবোধ আসবে না। তাই বলছি হাল না ছেড়ে এগিয়ে যান। বিদেশে এসে এখনো হয়ত মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু না, আমি হাল ছাড়ছি না। আপনারাও ছাড়বেন না, এতটুকুই অনুরোধ। আর হ্যাঁ, কারো কিছু পছন্দ না হলে তাকে উৎসাহ দিতে না পারেন কিন্তু নেতিবাচক কথা বলবেন না।
আর বাবা-মা যেমনই হোক, আমার বিশ্বাস আমরা ভালো থাকলে তারাও ভালো থাকবেন একটা সময়। (যদিও এখনও দেশে কথা হলে ঝগড়া বেশি হয় একই কারণে যে তাদের অমুক আত্মীয় এই কথা বলেছে, তাদের ছোটো হতে হয়েছে।) কিন্তু তারপরেও সবাইকে বলছি হয়ত বাবা-মা আর আমাদের ভালো থাকা এক না। হয়ত তারা বারবার আপনার স্বপ্নপূরণে বাধা দিবে, কারণ তাদের সুখের সংজ্ঞা আর আপনার সংজ্ঞা এক না। তারপরেও এগিয়ে যেতে হয়। আর এগিয়ে যেতেই হবে আমাদের। নাহলে যে আপনি নিজে কোনোদিন সুখী হতে পারবেন না!
- ধন্যবাদ


No comments: