Thursday, December 11, 2014

আমার দেশের বাইরে আসা (by মুক্ত পাখি)

যখন আমি স্কলারশিপ পেলাম, তখন সবার আগে মনে হয়েছিল আমার এই অর্জনকে কে কীভাবে দেখবে। আমি এমন একটা পরিবারে মানুষ যেখানে মেয়েদের কে একমাত্র গুরুত্ব দেয়া হতো সে কতটুকু সুন্দর সেটা দেখে। কেন আমি এত খাটো, কেন আমি এত মোটা তাই নিয়ে আম্মা সারাদিন বকত। কাজিনদের (সমাজের কাছে তারা সুন্দর কারণ তারা লম্বা আর ফর্সা) সাথে তুলনা দিত। আমার সমসায়িক ছিল আমার এক খালাত ভাই। সারাদিন তার জ্ঞানের উদাহরণ দিত। যদিও সে ক্লাস এর মাঝের দিকের ছাত্র ছিল, তুলনামুলকভাবে স্কুলে আমার পজিশন ভালো ছিল, তাও আমি শুনতাম তার মতো ব্রিলিয়ান্ট নাকি জগতে নাই, ক্লাসের ফার্স্ট বয় নাকি তার কাছে থেকে পড়া বুঝে। তাকে নিয়ে আমার মা বাবার গল্পের শেষ নেই, মাঝে মাঝে মনে হতো আমি কি আদৌ আছি কোথাও? আত্মীয়স্বজনরাও একই কাজ করত। এস এস সি, এইচ এস সি দুটোতেই জি পি এ ৫ পেয়ে আমি বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ভাইটি তেমন কোন ভালো জায়গাতে চান্স পেল না। যেসব যায়গা তে সে চান্স পাবে বলে আমার মা-বাবাসহ সবাই গ্যারান্টি দিয়ে রেখেছিল আমাকে খোঁটা দিত: "তুই তো বাপের টাকা নষ্ট করবি, গিয়ে ভর্তি হবি প্রাইভেটে।" এদের সবাইকে দুঃখ দিয়ে আমি টিকে গেলাম সব জায়গায়। সবচেয়ে আজব ব্যাপার আমার মা-বাবাই মনে হয় বেশি দুঃখ পেল। আত্মীয়দের কথা বাদ দেই, আমার মা-বাবাই দেখি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে আমার তো মাথায় বুদ্ধি নাই, তাই সারাদিন মুখস্থ করি আর তাই সব জায়গাতে চান্স পেয়েছি। আমার কাজিন অনেক ব্রিলিয়ান্ট, খালি মুখস্থবিদ্যা নাই দেখে চান্স পায় নাই। কী আর বলব!
এরপরে এলো সবচেয়ে অদ্ভুত থিওরি। আমার আত্মীয়রা নাকি খুবই নিশ্চিন্ত আমি ভালো জায়গায়ে ভর্তি হওয়ায়, কারণ এতে আমার ভালো বিয়ে হবে (ভালো ইউনিভারসিটির নাম দেখিয়ে!!!)। বাকিদের তো চিন্তা নাই, কারণ তারা দেখতে সুন্দর!
পাস করে বের হয়ে আমি রিসার্চ আসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমার ইউনিভারসিটিতেই একটা কাজ শুরু করলাম। বুঝতেই পারছেন মাইনে তেমন না। ভাই এর মধ্যে ঢুকে গেছে ব্যাংকে। শুরু হলো আবার সবাই মিলে, কী হলো এত ভালো জায়গায় পড়ে? কয় টাকা মাইনে পাও? ও জানো ৬০ হাজার মাসে পায়। শুরুতেই এত পায়, বুঝো পরে কত পাবে। তুমি কী করলা? ব্রেইন না থাকলে তো এমনই হবে! আজও বুঝলাম না আমি কত পাই এইটা কেন আমার সবাইকে জানাতে হবে। আর আমার রিসার্চ করতে ভালো লাগে করলাম, তার ব্যাংক ভাল লাগে সে করবে, এখানে তুলনার কী হলো? খালা, আম্মা এবং অন্যান্যরা দেখি বিয়েবাড়িতেও ছেলের স্যালারির ব্রান্ডিংয়ে ব্যস্ত। আমার যে কী লজ্জা লাগত! মানুষজন না জানি কী ছোটলোক ভাবছে আমাদের! আর আমার মায়ের সে কী রাগ আমার উপর! আমি কেন ভালো কাপড়চোপড় পরে, সেজেগুজে কোথাও যাই না, কোনো বিয়ের প্রপোজাল আসে না, তার আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। আত্মীয়রা খালি গল্প করে তাদের স্কুলে পরা মেয়েরও নাকি বিয়ের প্রপোজাল আসে, তারা এতই সুন্দর। আম্মার খুব নিজেকে ছোট মনে হয় কারণ সে এইসব গল্প কাউকে করতে পারে না। কারণ আমাকে কারো বাসায় বা বিয়েবাড়িতে দেখেও কোনো বিয়ের প্রপোজাল আসে না। আমি খুব ক্যাজুয়াল থাকি দেখে সে নাকি সবার কাছে ছোট হয়!
এরপরে রিসার্চার হিসেবেই একটা অনেক বিখ্যাত সংস্থায় চাকরি নেই। বলাবাহুল্য আমার আম্মাই কনফিউজড আমি কীভাবে এই জব পেলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল কত বেতন? বলি নাই, কারণ আমি চাই না এটা নিয়ে একটা তুলনা হোক। অনেক রাগ করেছে আম্মা আব্বা দুজনই আমার উপর। কারণ তাদের আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করছে তারা বলতে পারে নাই দেখে তাদের নাকি বলছে যে দেখ কেরানির চাকরি পাইছে (আমি যা খুশি করি তোদের তাতে কী, কোন জবটা ভালো এটা কি তোরা বিচার করবি?) । তারপরেও আব্বা আম্মা আমার উপরে রাগ। বললাম এই সব আত্মীয়দের সাথে মেশার দরকার কী? শুনতে পেলাম তুমি আসামাজিক হতে পারো কিন্তু আমাদের আত্মীয়স্বজন লাগে। সমাজে চলতে গেলে এদের কথা শুনে চলতে হয়। খুব ইচ্ছা করছিল জিজ্ঞেস করতে যে খালি তো দেখি তোমরাই কথা শুনো কিন্তু এরা কবে কী শুনছে তোমাদের? সেদিন বলি নাই, পরে বলছিলাম কি না মনে নাই, কারণ এই জবটার পরে থেকে বাসায় আমার প্রায়ই ঝগড়া হতো। তাদের নাকি আমার বিয়ের প্রপোজাল আসে না, আমি স্যালালির কথা বাসায় শেয়ার করি না, জব করে করে মেয়ের চেহারা আর খারাপ হয়ে গেছে (জব ছেড়ে বাসায় বসে রূপচর্চা করলেও তো বিয়ের প্রপোজাল আসার চান্স থাকে) এই সব শুনতে হয় আর তাই আমার উচিত এখন সবার আগে বিয়ে করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বাবা মা তাদের কথার প্রতিবাদ না করে আমার উপর এসে উলটা মানসিক চাপ দিত।
এরপরেও দেশের বাইরে অ্যাপ্লাই করে গেছি বারবার। অন্তত ২০-২২ বার অ্যাপ্লাই করেছি এই ৪ বছরে। ৪ বছর পরে কোথাও একটা ভালো ফান্ডিং প্যাকেজ পেলাম। আম্মা ২ বছর আগে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিল যে আমি খালি টাকা নষ্ট করছি অ্যাপ্লাই করে। মাথায় ঘিলু নাই, এইটা বাংলাদেশে। কেউ না বুঝলেও বিদেশি তো আর বলদ না। আমার কিছুই কখনও হবে না। স্কলারশিপের খবরটা পেয়ে কোনো রিঅ্যাকশন বা তেমন কিছু দেখি নাই। কিছুদিন পরে খবর আনলেন আমার এক নিকট আত্মীয় তাকে জানিয়েছে যে কানাডা হলেও আমার ইউনিভারসিটির সিরিয়াল (ranking) অনেক পরে। মনে হল আম্মা আব্বা কিছুটা হলেও শান্তি পেল, আমি আমার খালাত ভাইয়ের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে গেলে যে আত্মীয়রা তাদের কথা শুনাবে আর তারা লজ্জা পাবে, ছোটো হবে।
আমরা অনেকেই হয়ত এই সব নেগেটিভিটির মধ্যে বড় হয়েছি। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। মাঝেমাঝেই মনে হয় অসহ্য, সব ছেড়ে দেই। কিন্তু ছেড়ে দিলে আর নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবেন না। আত্মসম্মানবোধ আসবে না। তাই বলছি হাল না ছেড়ে এগিয়ে যান। বিদেশে এসে এখনো হয়ত মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু না, আমি হাল ছাড়ছি না। আপনারাও ছাড়বেন না, এতটুকুই অনুরোধ। আর হ্যাঁ, কারো কিছু পছন্দ না হলে তাকে উৎসাহ দিতে না পারেন কিন্তু নেতিবাচক কথা বলবেন না।
আর বাবা-মা যেমনই হোক, আমার বিশ্বাস আমরা ভালো থাকলে তারাও ভালো থাকবেন একটা সময়। (যদিও এখনও দেশে কথা হলে ঝগড়া বেশি হয় একই কারণে যে তাদের অমুক আত্মীয় এই কথা বলেছে, তাদের ছোটো হতে হয়েছে।) কিন্তু তারপরেও সবাইকে বলছি হয়ত বাবা-মা আর আমাদের ভালো থাকা এক না। হয়ত তারা বারবার আপনার স্বপ্নপূরণে বাধা দিবে, কারণ তাদের সুখের সংজ্ঞা আর আপনার সংজ্ঞা এক না। তারপরেও এগিয়ে যেতে হয়। আর এগিয়ে যেতেই হবে আমাদের। নাহলে যে আপনি নিজে কোনোদিন সুখী হতে পারবেন না!
- ধন্যবাদ


অদৃশ্য (by Farhin Sohan Kabir Lita)

অদৃশ্য হয়ে যাবার কথা ভেবেছেন কখনো? আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, সবার মাঝ দিয়ে আমি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি। কি দুর্দান্ত হতো, তাই না?
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, যেখানে পথে নামলেই গায়ে গা ঠেকিয়ে হেঁটে চলা অগণিত ব্যস্ত মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, সেই শহরে অদৃশ্য হয়ে যেতে কী করতে হয়?
ঘরের দরজা খুলে বাইরে বের হওয়ামাত্র, একটা মেয়ে টের পায়, অগণিত জোড়া জোড়া চোখ লক্ষ্য করছে তাকে। কেউ নজর পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, কেউ মুখের আদলটা দেখে নেয় একটুখানি, কারও দৃষ্টি স্ক্যানারের মতো স্ক্যান করে যায় মেয়েটার সর্বাঙ্গ। এদের মধ্যে বেশ কয়েক জোড়া চোখ, ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। এই টের পাওয়াটুকু, অসংখ্য জোড়া জোড়া চোখের ফোকাস বিন্দুতে থাকার অস্বস্তিটুকুর সাথে আমরা মানিয়ে গিয়েছি, এটা এখন আমাদের প্রাত্যহিক চলাফেরার সঙ্গে মিশে গেছে।
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, একটা মেয়ের অদৃশ্য হয়ে যেতে কী করতে হয়?
আমি বলে রাখছি, এটা নিতান্তই আমার নিজস্ব এবং কাকতালীয় একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিজস্ব কিছু বক্তব্য মাত্র। আমি কাউকে এটা করতে উৎসাহিত করছি না।
শীতের সন্ধ্যা। কোনো একটা কাজ সেরে ফিরছি। রিকশায় বসে আমি, চোখে চশমা, পরনে নীল জিন্স। গায়ে একটা কোমর অব্দি লম্বা কালো ফতুয়ার ওপরে ভারী হুডি সোয়েটার চড়িয়ে রেখেছি। পায়ে আমার নিত্য সঙ্গী রঙচটা কনভার্স জুতো।
এই শহরেরই কোনো ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে রিকশা যাচ্ছে আমার, রিকশার হুড অবহেলায় ফেলে রাখা, আমার সারা জীবনের অভ্যেস। কী মনে হতে, আমি আমার সোয়েটারের হুড তুলে দিলাম মাথায়। আমার অবিন্যস্ত চুলগুলো ঢেকে গেলো, চশমা পড়া চোখ আড়াল হয়ে গেলো কালো হুডের নিচে, মুখমণ্ডলের একমাত্র দৃশ্যমান অংশ বলতে রইলো আমার চোয়ালটুকু, সেই সাথে হাতের কবজি অব্দি খোলা।
কয়েক মিনিট পরে আমার চমকাবার পালা। কিছু একটা বদলে গেছে। কিছু একটা আর আগের মতো নেই। আমি খেয়াল করলাম, আমার দিকে আর কেউ তাকাচ্ছে না। কেউ না।
আমি অদৃশ্য! অগণিত জোড়া চোখের ফোকাস বিন্দু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে পারার সেই অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিটুকু ছিলো অন্যরকম। যেন অন্য একটা ভাষা, আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু ফুটিয়ে বলতে পারছি না। আমি বোঝাতে পারবো না সেই ভালোলাগাটুকুর কথা।
খেয়াল করুন, সেই মুহূর্তে, পোশাকে আশাকে আমার সাথে কোনো পুরুষের পার্থক্য ছিলো না। দেড় কোটি মানুষের (!) এই শহরে, পচাত্তর লাখ সাধারণ(!) পুরুষের কাতারে চলে গিয়েছিলাম আমি, হয়ে গিয়েছিলাম নজরের আড়াল।
দেড় কোটি মানুষের এই শহরে, একজন মেয়ে হিসেবে অবজেকটিফাইড না হবার সেই কয়েকটা মিনিট, আমার জীবনের স্মরণীয় সময়গুলোর মধ্যে তোলা থাকবে।

Wednesday, September 24, 2014

আমার মা (by শান্তা হোসাইন)

এই গল্পের প্রধান চরিত্র একজন মা। সম্পর্কের সূত্রে ঊনি আমার মা। আমার মায়ের মতো এমন অনেক মা ছড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের অনেক গলিতেই। তাদের গল্পগুলো অজানাই থেকে যায়। সেই তাগিদ থেকেই আমার এই কাঁচা হাতের লেখা।

আমার মায়ের বিয়ে হয় আনুমানিক ১৩/১৪ বছর বয়সে। মোটামুটি ধনী পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন উনি। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। আমার বাবা একজন চাকুরিজীবী ছিলেন। সচ্ছল পরিবার। কঠিন বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে রান্নাবান্না, ছেলেমেয়ে, মানুষ আর বেগম পত্রিকার পাতা উলটায়ে তার জীবন চলে যাচ্ছিল। দস্যু বনহুর পড়তে পড়তে দুধ পোড়ানো ছাড়া জীবন তার মোটামুটি নিরুত্তাপই ছিল।

আমার মা যখন বিধবা হয়, তখন আমার মায়ের আনুমানিক বয়স ৩০। ৪ সন্তান। বড় ভাইয়া ১৩ বছরের, ছোট ভাইয়া ১২, আপু ৪ আর আমি তখন ১ বছরের। আমার আব্বা মারা যাওয়ার সময় একটি ব্যাংকে ম্যানেজার হিসাবে চাকুরিরত ছিলেন। বাবার সঞ্চয়ের অভ্যাস ছিল না। উপরন্তু ছিল সাহায্য করার এক তীব্র মানসিকতা। এমনকি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা লোন নিয়ে খুব কাছের মানুষদের সাহায্য দিয়েছিলেন। তাই আব্বা মারা যাওয়ার পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাও আম্মা সম্পূর্ণ পায়নি।

চার সন্তান নিয়ে বিধবা আমার মা তখন দিশেহারা। নানাবাড়ি ততদিনে প্রায় শূন্য। মানুষও নাই, প্রাচুর্যও নাই। দাদাও মারা গেছেন ততদিনে। দাদী বৃদ্ধা।  আমার মায়ের মুখে শুনেছি বাবা মারা যাওয়ার পর শোক ছাপিয়ে আমাদের নিয়ে এক গভীর দুশচিন্তা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। এদিকে আব্বা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহের মাঝেই আম্মার সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। সে নাকি ঠিকমতো শোক পালন করছে না।পরনে রঙিন শাড়ি তখনো! যা-ই হোক। মূল সমস্যা তখন কোথায় থাকবে সে? যারা দায়িত্ব নিতে পারত, নেওয়া উচিত ছিল, যাদের বিত্তর উৎস ছিল আমার বাবার সাহায্য তাঁরা আমাদের পরিবারের দায়িত্ব অস্বীকার করল। আত্মীয় স্বজনের পরামর্শ আসল, গ্রামে চলে যাও। জমিজমা আছে। চলে যাবে।

আমার মা ভাবলেন, গ্রামে চলে গেলে তার ছেলেমেয়েদের আর পড়াশোনা হবে না। আম্মা বললেন, উনি আব্বার চাকুরিস্থলেই (একটি জেলা শহর, সেখানে আমাদের কোনো আত্মীয় ছিল না) থাকবেন। আত্মীয়স্বজনদের তখন আক্কেলগুড়ুম। কোনো অভিভাবক ছাড়া একা এক শহরে!! শুরু হয়ে গেল চরিত্রের উপর হামলা। " যেই টাকাপয়সা পাবে সেটা ফূর্তি করবে। তাই গ্রামে আসতে চায় না। ছেলেমেয়ের পড়শোনা তো হবে না, চোর বদমাশ হবে। ছিনতাই করতে নামলো বলে ছেলেরা"!

না। আমার মা কিছুই পাত্তা দেয়নি আমাদের কথা ভেবে। আত্মীয়দের একটা বিশাল অংশ রীতিমতো আমাদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমার মা স্কুল পাশের আগে বিয়ে হয়েছিল। কোনো চাকরি করা সম্ভব ছিল না।  সেই আমলে মহিলাদের কাজের সুযোগও এত ছিল না। যা-ই হোক, আমার বাবার কিছু বন্ধু পরিবারের সহায়তায় সেই অল্প কিছু টাকাকে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করে আমাদের সংসার আগাতে থাকে। কিছু কিছু পরিবারের কাছে এজন্য আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। এবং তারা কেউই আমাদের আত্মীয় নন। আমার মায়ের দৃঢ়তা এবং অবশ্যই আল্লাহর রহমতে আজ আমার বড় ভাই ডাক্তার। ছোট ভাইয়া একটা অসফল বাইপাস সার্জারির মাধ্যমে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে ও বিকম পাস করে, সিএ কোর্সটা কমপ্লিট করেছিল। আপু এখন একটা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। আর আমি ডাবল মাসটার্স শেষে পি এইচ ডি করব ভাবছি।

ভাইয়া মেডিক্যাল পড়া অবস্থায় ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজন পুনরায় যোগাযোগ শুরু করে। এখন সবকিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু সবকিছুই অনেক অন্যরকম হতে পারত। অনেক খারাপ হতে পারত। পড়াশোনা না জানার ফলে আমার মা যে কষ্ট পেয়েছে, আমাদের সেই আক্ষেপটা যেন না থাকে, তার জন্য আমার মা তার সাধ্যের বাইরে যেয়ে চেষ্টা করেছে!

আমি আমার মাকে কখনও লাল শাড়ি পরতে দেখি নাই। কখনও লিপস্টিক দিতে দেখি নাই। চোখে কাজল দিতে দেখি নাই। যে সমাজ সাজতে বাধ্য করে, সেই সমাজই আবার বাঁকা চোখে তাকাবে আমার মায়ের সাজ দেখলে। আমার মা আমাদের জন্য সেই রিস্ক নিতে চায়নি।

বাবা মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে নাকি আম্মা আবদার করেছিল কিছু নতুন শাড়ী কিনে দেওয়ার। বাবা নাকি সবসময় টালবাহানা করত। কিন্তু সেবার করে নাই। বলেছিল, ঠিক আছে, টাকা দিব, নিয়ে এসো। আমার মা অবাকই হয়েছিল। কী হল মানুষটার? সে টাকা আর বাবার দেওয়া হয়নি। একথা গুলো আসলে কান পেতে শোনা। যখন আম্মা অন্য কারও সাথে গল্প করছে। আমার মা আমাকে এই গল্পগুলো শোনায় না।

আমার মাকে প্রায় এক যুগেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে সেই শাড়ী কেনার জন্য। নিতান্তই সুতির শাড়ী ছাড়া কখনো দেখি নাই নিজের জন্য একটা শাড়ি কিনেছে। না, ঈদ এও না। আর সাজসজ্জা তো সমাজ থেকেই নিষিদ্ধ।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলেও হয়ত আমি এত স্বাধীন, সাবলম্বী জীবন পেতাম না। আমার জন্ম ছাড়া, আমার জীবনে আমার বাবার কোনো ভুমিকা নাই। (যদিও আমার মা ভিন্ন কথা বলে। আম্মা বলে, আব্বা একজন সৎ চাকুরিজীবী ছিলেন দেখেই আমরা মানুষ হয়েছি। অসৎ হয়ে অনেক টাকা পয়সা রেখে গেলে উলটা হইত! )

একটা পরিবারে সন্তান অস্বাভাবিক কিছু করলে মায়ের উপর হামলে পড়ে সমাজ। আমার মা তো এক অর্থে সিঙ্গেল মা-ই ছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা কোনো পত্রিকা বলবে না। সমাজ স্বীকৃতি দিবে না। ভাবটা এমন... করারই তো কথা!!! আসুন আমরা মাদের, তাদের ত্যাগ আর একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। এই গল্পটা শুধু সামাজিক আর অর্থনৈতিক সংঘাতের ক্ষুদ্র নমুনা। একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে কিভাবে ঊনি নিজের ব্যক্তিত্বকে নতুন মোড়কে সাজিয়েছিলেন, সন্তানদের বাবার অভাব ভুলতে সাহায্য করেছিলেন, প্রতিটা সন্তান হোঁচট খাওয়ার পর একা কীভাবে সামলেছেন , হাত ধরে তুলেছেন, সে গল্প সুযোগ পেলে অন্য কখনো বলব।

আমার মা খুব ঘুরতে পছন্দ করে, এটা বছরখানেক হল জানতে পেরেছি। আগে তো সুযোগ আর সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না। এখন আমি সারাক্ষণ প্রার্থনা করি, আমি যেন আম্মাকে পৃথিবী দেখানোর সুযোগ পাই।

ধন্যবাদ এতটা সময় নিয়ে পড়ার জন্য। ভাল থাকবেন।


ছবির সূত্র: http://myblog.rocks/nature-always-finds-a-way-never-give-up/