Wednesday, September 24, 2014

আমার মা (by শান্তা হোসাইন)

এই গল্পের প্রধান চরিত্র একজন মা। সম্পর্কের সূত্রে ঊনি আমার মা। আমার মায়ের মতো এমন অনেক মা ছড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের অনেক গলিতেই। তাদের গল্পগুলো অজানাই থেকে যায়। সেই তাগিদ থেকেই আমার এই কাঁচা হাতের লেখা।

আমার মায়ের বিয়ে হয় আনুমানিক ১৩/১৪ বছর বয়সে। মোটামুটি ধনী পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন উনি। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। আমার বাবা একজন চাকুরিজীবী ছিলেন। সচ্ছল পরিবার। কঠিন বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে রান্নাবান্না, ছেলেমেয়ে, মানুষ আর বেগম পত্রিকার পাতা উলটায়ে তার জীবন চলে যাচ্ছিল। দস্যু বনহুর পড়তে পড়তে দুধ পোড়ানো ছাড়া জীবন তার মোটামুটি নিরুত্তাপই ছিল।

আমার মা যখন বিধবা হয়, তখন আমার মায়ের আনুমানিক বয়স ৩০। ৪ সন্তান। বড় ভাইয়া ১৩ বছরের, ছোট ভাইয়া ১২, আপু ৪ আর আমি তখন ১ বছরের। আমার আব্বা মারা যাওয়ার সময় একটি ব্যাংকে ম্যানেজার হিসাবে চাকুরিরত ছিলেন। বাবার সঞ্চয়ের অভ্যাস ছিল না। উপরন্তু ছিল সাহায্য করার এক তীব্র মানসিকতা। এমনকি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা লোন নিয়ে খুব কাছের মানুষদের সাহায্য দিয়েছিলেন। তাই আব্বা মারা যাওয়ার পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাও আম্মা সম্পূর্ণ পায়নি।

চার সন্তান নিয়ে বিধবা আমার মা তখন দিশেহারা। নানাবাড়ি ততদিনে প্রায় শূন্য। মানুষও নাই, প্রাচুর্যও নাই। দাদাও মারা গেছেন ততদিনে। দাদী বৃদ্ধা।  আমার মায়ের মুখে শুনেছি বাবা মারা যাওয়ার পর শোক ছাপিয়ে আমাদের নিয়ে এক গভীর দুশচিন্তা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। এদিকে আব্বা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহের মাঝেই আম্মার সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। সে নাকি ঠিকমতো শোক পালন করছে না।পরনে রঙিন শাড়ি তখনো! যা-ই হোক। মূল সমস্যা তখন কোথায় থাকবে সে? যারা দায়িত্ব নিতে পারত, নেওয়া উচিত ছিল, যাদের বিত্তর উৎস ছিল আমার বাবার সাহায্য তাঁরা আমাদের পরিবারের দায়িত্ব অস্বীকার করল। আত্মীয় স্বজনের পরামর্শ আসল, গ্রামে চলে যাও। জমিজমা আছে। চলে যাবে।

আমার মা ভাবলেন, গ্রামে চলে গেলে তার ছেলেমেয়েদের আর পড়াশোনা হবে না। আম্মা বললেন, উনি আব্বার চাকুরিস্থলেই (একটি জেলা শহর, সেখানে আমাদের কোনো আত্মীয় ছিল না) থাকবেন। আত্মীয়স্বজনদের তখন আক্কেলগুড়ুম। কোনো অভিভাবক ছাড়া একা এক শহরে!! শুরু হয়ে গেল চরিত্রের উপর হামলা। " যেই টাকাপয়সা পাবে সেটা ফূর্তি করবে। তাই গ্রামে আসতে চায় না। ছেলেমেয়ের পড়শোনা তো হবে না, চোর বদমাশ হবে। ছিনতাই করতে নামলো বলে ছেলেরা"!

না। আমার মা কিছুই পাত্তা দেয়নি আমাদের কথা ভেবে। আত্মীয়দের একটা বিশাল অংশ রীতিমতো আমাদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমার মা স্কুল পাশের আগে বিয়ে হয়েছিল। কোনো চাকরি করা সম্ভব ছিল না।  সেই আমলে মহিলাদের কাজের সুযোগও এত ছিল না। যা-ই হোক, আমার বাবার কিছু বন্ধু পরিবারের সহায়তায় সেই অল্প কিছু টাকাকে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করে আমাদের সংসার আগাতে থাকে। কিছু কিছু পরিবারের কাছে এজন্য আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। এবং তারা কেউই আমাদের আত্মীয় নন। আমার মায়ের দৃঢ়তা এবং অবশ্যই আল্লাহর রহমতে আজ আমার বড় ভাই ডাক্তার। ছোট ভাইয়া একটা অসফল বাইপাস সার্জারির মাধ্যমে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে ও বিকম পাস করে, সিএ কোর্সটা কমপ্লিট করেছিল। আপু এখন একটা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। আর আমি ডাবল মাসটার্স শেষে পি এইচ ডি করব ভাবছি।

ভাইয়া মেডিক্যাল পড়া অবস্থায় ধীরে ধীরে আত্মীয়স্বজন পুনরায় যোগাযোগ শুরু করে। এখন সবকিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু সবকিছুই অনেক অন্যরকম হতে পারত। অনেক খারাপ হতে পারত। পড়াশোনা না জানার ফলে আমার মা যে কষ্ট পেয়েছে, আমাদের সেই আক্ষেপটা যেন না থাকে, তার জন্য আমার মা তার সাধ্যের বাইরে যেয়ে চেষ্টা করেছে!

আমি আমার মাকে কখনও লাল শাড়ি পরতে দেখি নাই। কখনও লিপস্টিক দিতে দেখি নাই। চোখে কাজল দিতে দেখি নাই। যে সমাজ সাজতে বাধ্য করে, সেই সমাজই আবার বাঁকা চোখে তাকাবে আমার মায়ের সাজ দেখলে। আমার মা আমাদের জন্য সেই রিস্ক নিতে চায়নি।

বাবা মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে নাকি আম্মা আবদার করেছিল কিছু নতুন শাড়ী কিনে দেওয়ার। বাবা নাকি সবসময় টালবাহানা করত। কিন্তু সেবার করে নাই। বলেছিল, ঠিক আছে, টাকা দিব, নিয়ে এসো। আমার মা অবাকই হয়েছিল। কী হল মানুষটার? সে টাকা আর বাবার দেওয়া হয়নি। একথা গুলো আসলে কান পেতে শোনা। যখন আম্মা অন্য কারও সাথে গল্প করছে। আমার মা আমাকে এই গল্পগুলো শোনায় না।

আমার মাকে প্রায় এক যুগেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে সেই শাড়ী কেনার জন্য। নিতান্তই সুতির শাড়ী ছাড়া কখনো দেখি নাই নিজের জন্য একটা শাড়ি কিনেছে। না, ঈদ এও না। আর সাজসজ্জা তো সমাজ থেকেই নিষিদ্ধ।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলেও হয়ত আমি এত স্বাধীন, সাবলম্বী জীবন পেতাম না। আমার জন্ম ছাড়া, আমার জীবনে আমার বাবার কোনো ভুমিকা নাই। (যদিও আমার মা ভিন্ন কথা বলে। আম্মা বলে, আব্বা একজন সৎ চাকুরিজীবী ছিলেন দেখেই আমরা মানুষ হয়েছি। অসৎ হয়ে অনেক টাকা পয়সা রেখে গেলে উলটা হইত! )

একটা পরিবারে সন্তান অস্বাভাবিক কিছু করলে মায়ের উপর হামলে পড়ে সমাজ। আমার মা তো এক অর্থে সিঙ্গেল মা-ই ছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা কোনো পত্রিকা বলবে না। সমাজ স্বীকৃতি দিবে না। ভাবটা এমন... করারই তো কথা!!! আসুন আমরা মাদের, তাদের ত্যাগ আর একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। এই গল্পটা শুধু সামাজিক আর অর্থনৈতিক সংঘাতের ক্ষুদ্র নমুনা। একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে কিভাবে ঊনি নিজের ব্যক্তিত্বকে নতুন মোড়কে সাজিয়েছিলেন, সন্তানদের বাবার অভাব ভুলতে সাহায্য করেছিলেন, প্রতিটা সন্তান হোঁচট খাওয়ার পর একা কীভাবে সামলেছেন , হাত ধরে তুলেছেন, সে গল্প সুযোগ পেলে অন্য কখনো বলব।

আমার মা খুব ঘুরতে পছন্দ করে, এটা বছরখানেক হল জানতে পেরেছি। আগে তো সুযোগ আর সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না। এখন আমি সারাক্ষণ প্রার্থনা করি, আমি যেন আম্মাকে পৃথিবী দেখানোর সুযোগ পাই।

ধন্যবাদ এতটা সময় নিয়ে পড়ার জন্য। ভাল থাকবেন।


ছবির সূত্র: http://myblog.rocks/nature-always-finds-a-way-never-give-up/

No comments: