Saturday, April 7, 2012

মিতুলের সংসার

You never know how strong you are until being strong is the only option for you...


মাস ছয়েক আগের কথা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিলো মিতুলের। বিনানোটিশে তালাকনামা এলো শ্বশুরপক্ষ থেকে। ওর সব গয়নাগাটি, জিনিসপত্র আত্মসাৎ করে রেখে দিলো ওরা। এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলো মিতুল। বাবা মারা গেছিলেন ওর বিয়ের পরপরই। মিতুল বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান।  পারিবারিকভাবেই পরিচয় হয়েছিলো ভালোবাসার মানুষটার সাথে। তারপর প্রেম, বিয়ে। যে মানুষটাকে দুটা বছর পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো সে কী করে পারল এমনটা করতে? তাও কিনা যৌতুকের জন্য!

বাবা চলে যাওয়ার পরে মা থাকতেন নানীর বাসায়। দুবছরের সংসার ছেড়ে মিতুল গিয়ে উঠল সেখানে।

কী অসহায় একেকটা দিন! নতুন জব। ঘণ্টা মেপে টাকা পায়। তখনো ট্রেইনি। ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলো না। হাতেগোনা কিছু টাকা নিয়ে বাসায় ফিরত। নানা-নানী না থাকলে নানীবাড়ির আদরও থাকে না। মামীর মুখ ভার। তাও দুমাস দাঁত কামড়ে ওখানে থেকে যায় মিতুল।

সবাই বলতে লাগল শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে লিগ্যাল কোনো অ্যাকশন কেন নিচ্ছে না। শ্বশুরপক্ষ জানিয়েছে ইদ্দতের ৯০ দিন পেরিয়ে গেলে ফার্নিচার আর অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে দেবে। কিন্তু ততদিনে ওরা গয়না বিক্রি করে চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে মিতুল নাকি নিজের গয়না সরিয়ে ফেলেছে। রাগে গা জ্বলে যায়! ওর কাছে কোনো প্রমাণও নেই যে ও শাশুড়ির কাছে গয়না রেখেছিলো। সবাই তেড়ে আসে... “শাশুড়ির কাছে কেউ গয়না রাখে?”... মিতুল ভাবে, “অবিশ্বাস করে কি কেউ সংসার করে? উনারা হজ্জ করে এসে এহেন নীচ কাজ করতে পারেন সে কি আমি জানতাম?”

সবদিক দিয়েই যখন তালমাতাল অবস্থা, মিতুল ভাবে- অতীত না ভবিষ্যৎ? তারপর সিদ্ধান্ত নেয় অতীতকে আঁকড়ে ধরে না থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। সব দাবিদাওয়া তুলে নিলো। শ্বশুরপক্ষকে দিয়ে দিলো সব। টাকাপয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে জাহান্নামে যাক নোংরা মানুষগুলো। এই পশুদের হাত থেকে বাঁচতে তো পারল অন্তত। ধরে নিলো জানের সদকা হিসেবে দিয়ে দিয়েছে সবকিছু মিতুল। “সব দিয়ে দিলাম! যাহ! মর!”

ডিভোর্স হয়েছিলো মিতুলের সেকেন্ড অ্যানিভার্সারির দিনে। ডিভোর্স পেপারটার দিকে ঠায় চেয়ে ছিলো মিতুল। ভাবছিলো ওর হাজবেন্ডের কি একটাবারও হাত কাঁপেনি সাইন করার সময়? দুটা বছর এক মুহূর্তের জন্যও কি ভালোবাসেনি ওকে? শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু আশা করে লাভ নেই। ডিভোর্সের পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে মিতুল জানতে পেরেছে, পরেরটা মেরে খাওয়া ওর শ্বশুরশাশুড়ির পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু যে মানুষটার হাত ধরেছিলো পরম বিশ্বাসে সে কী করে পারল?
মিতুলের বিয়ের নয় মাসের মাথায় ওর বাবা হার্ট ফেইল করে মারা যান ওর চোখের সামনেই। সেই শক থেকে বেরিয়ে আসতেই অনেকদিন লেগেছে। ইমশোনালি অনেক বেশি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছিলো হাজবেন্ডের উপর। ওকে ছাড়া কিছুই বুঝত না মিতুল। তবে সমস্যা ছিলো অন্যখানে...

বিয়ের পর থেকেই ওদের ফিজিক্যাল রিলেশনশিপে কিছু সমস্যা ছিলো। বুঝে উঠতে অনেক সময় লেগে গেছে। কোথায় যেন কী নেই। রেগুলারিটি ছিলো না কোনো। ওর হাজবেন্ডের ছিলো ভীষণ অনীহা। তার ইরেক্টাইল ডিসফাংশন ছিলো। মিতুল ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অনুরোধ করল। ততদিনে বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে। বাচ্চা নেওয়ার একটা চাপ ছিলো ফ্যামিলি থেকে। মিতুলেরও ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। না ছিলো ফিজিক্যাল স্যাটিসফ্যাকশন, না বাচ্চাকাচ্চা। মিতুলও ডাক্তার দেখালো। ওর কোনো সমস্যা পাওয়া গেল না। ওর হাজবেন্ডও গেল। কিন্তু কোনো ডাক্তারের কাছেই একবারের বেশি যায় না সে। সেক্সোলোজিস্টের কাছেও যাওয়া হলো। অনেক কান্নাকাটি মান-অভিমানের পর। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিলো আর কিছু টেস্ট। হরমোন টেস্ট, স্পার্ম কাউন্ট আরো কী কী। হরমোন টেস্ট ছাড়া আর কোনো টেস্টের রিপোর্ট মিতুল দেখতে পায়নি। তবে ওর হাজবেন্ডের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন যে সিরিয়াস পর্যায়ে ছিলো তা বোঝা গেছিলো প্রেসক্রিপশনে ওষুধের লিস্টে ‘ভায়াগ্রা’র নাম দেখে। খুব সিরিয়াস অবস্থা না হলে কোনো ডাক্তার ভায়াগ্রা প্রেসক্রাইব করতে চায় না। মিতুলের সাথে ও হাজবেন্ডের দূরত্ব বাড়তে লাগল। মিতুল যতই চেষ্টা করে, কিছুতেই কিছু হয় না। প্রতি রাতেই হতাশা।

এদিকে বাচ্চা হয় না দেখে শাশুড়ি এমন কোনো কথা নেই যে শোনায়নি। মিতুলের হাজবেন্ড যাকে বলে পুরাপুরি ‘Momma’s Boy’। মিতুল যে তাকে সেক্সোলোজিস্টের কাছে নিয়ে গেছে সেটাও মাকে বলে দিয়েছে। এবং তারা ব্যাপারটাকে মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। মিতুলের উপর মানসিক অত্যাচার বাড়তে লাগল দিনেদিনে।

মিতুল এমবিএ করছিলো। ওকে বলা হলো পড়ালেখা বন্ধ করে ‘সংসারে মন দিতে’। ওদিকে শ্বশুর মিতুলের মা-কে চাপ দিতে লাগলো তার ছেলেকে (মিতুলের হাজবেন্ডকে) ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে দিতে। তার ভাষায়, “যা দিয়েছেন সবই তো মেয়েকে, আমার ছেলেকে কী দিলেন?” মিতুল প্রতিবাদ করল। ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। মা মেয়ে হসপিটালে থাকে। কেউ নেই পাশে। মিতুল আশা করেছিলো ওর হাজবেন্ড একটু সময় দেবে। তার অফিসে যাওয়া-আসার পথেই পড়ে হসপিটাল। আসে না। শ্বশুরশাশুড়ি একবার জিজ্ঞেসও করে না ওরা মা-মেয়ে কেমন আছে।

ওই অবস্থায় ২৮ সেপ্টেম্বর নতুন জবে জয়েন করল মিতুল। কল সেন্টারের জব। জয়েন করার পরদিন সকালের কথা। রাতে হালকা মান-অভিমান হয়েছিল। সকালে আদর করে জড়িয়ে ধরে মান ভাঙাতে গেল মিতুল। এমন জোরে ধাক্কা দিলো মিতুলকে যে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেলো ও। কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা পেল। সেই সাথে চিল্লাচিল্লি। সাতসকালে কেমন লাগে? মেজাজ চড়ে গেল মিতুলের।

অফিসে যাওয়ার আগে হসপিটালে মায়ের কাছে যাবে বলে বেরোলো মিতুল। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। ওর হাজবেন্ডই দরজা খুলে দিলো। বের হয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে একটা এসএমএস দিলো মিতুল, “tumi je amar sathe kaj ta korla, kototuku fair chilo?” এবং আরো অনেক কিছু। অত সকালে যেতে দেখে মিতুলের মা জানতে চাইল জামাইয়ের সাথে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। মিতুল বললো “হালকা মান অভিমান, ঠিক হয়ে যাবে”। সেদিন মিতুলের মায়ের হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার কথা। চারটার মধ্যে অফিস থেকে বের হলো মিতুল। হসপিটাল থেকে বের হয়ে ওর মা বাসায় না গিয়ে মিতুলকে নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি গেল। ওর শ্বশুরশাশুড়ির সাথে কথা বলে কিছুদিনের জন্য মিতুলকে নিয়ে আসবে। সেদিনের কথা ভাবতে আজও নিজেকে ধিক্কার দেয় মিতুল। মিতুল আর তার অসুস্থ মা ওর শ্বশুরবাড়ির কলিং বেল চেপে যাচ্ছে। ওরা মিতুলদের দেখেও দরজা খুলছে না। পাশের বাড়ির লোকজন, দারোয়ান সবাই দেখছে।

মিতুল মা-কে নিয়ে ফিরে গেল নানীর বাসায়। মিতুল ওর কানাডা প্রবাসী ভাসুরকে ফোন করে জানালো। তাদের মুখে যা শুনল তাতে মিতুল আকাশ থেকে পড়ল। তাদেরকে নাকি বলা হয়েছে মিতুল হাজবেন্ডের সাথে মারামারি করে গহনাগাটি নিয়ে চলে এসেছে। ওর ভাসুরও অবাক। দুপক্ষের জবানিতে কোনো মিল নেই। সে মিতুলকে বললো কিছুদিন মায়ের কাছে থাকতে। সে দেখবে ব্যাপারটা। মিতুল সেই আশায় রইল। এর মধ্যে হাজবেন্ডের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকল। তার দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। একদিন এক ফুপাত ভাসুর ফোন করে জানালো মিতুলের নামে নাকি তার বাসায় ‘বিচার’ বসবে। ওর মা যেন ওকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত থাকে। মা বললো সমস্যা যেহেতু স্বামী-স্ত্রী দুজনের, সবাই একসাথে বসার আগে সে যেন (ফুপাত ভাসুর) ওদের দুজনকে নিয়ে বসে। তাতে সে রাজিও হলো। মিতুলের শ্বশুরবড়িতে সেই ভাসুরের উপস্থিতিতে মিতুল আর ওর হাজবেন্ডের কথা হলো ১ অক্টোবরে। অনেক প্রশ্ন করা হলো। মিতুল জানত না যে ওর সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছিলো। এক ভাসুর প্রস্তাব দিলো ওদের আলাদা সংসারের। মিতুল রাজি হয়নি। তার কথা, “আমার হাজবেন্ডকে আমি কেন তার প্যারেন্টসের কাছ থেকে আলাদা করব?”

এরপর সিদ্ধান্ত হলো যে ওরা হাজবেন্ড ওয়াইফ কিছুদিন আলাদা থাকবে, তারপর ওর হাজবেন্ড ওকে নিতে যাবে। মিতুল নিজেও চাচ্ছিলো কিছুদিন মায়ের কাছে থাকতে। ও রাজি হলো। যদি এতে ভালো কিছু হয় তো ক্ষতি কী?
সেই ফুপাত ভাসুরই গাড়িতে করে মিতুলদের পৌঁছে দিলেন ওর নানীর বাড়ি। মিতুল ওর হাজবেন্ডকে মিস করছিলো। মিতুল তখনো জানত না সেদিনের পর আর কখনো দুজন একসাথে বসে ভাত খাওয়া হবে না।

১৩ অক্টোবর ওর হাজবেন্ড ওদের (মিতুল আর ওর হাজবেন্ডের) পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের ওর সম্পর্কে বিশাল একটা মেইল পাঠায় যার ভাষা ছিলো এমন:

Dear ****:

It is for your information that my wife & I living separated from 29 September 2011. It was her decision to step out. I know three probable questions started roam your mind: Why?, How? and What?
Whatever the reasons for which she left, let it be personal as our parents already involved in this particular matter after she left. Presently she is staying with her mother.
I have just noticed that she blocked and delete me and my family members from her list in facebook but still communicating with my friends (mutually known to her through me). I am sure you also noticed that. Since she is known to you through me, it is my responsibility to inform you in this regard.
Please use your best conscious sense whether to keep contact with her or not. Please note, I won’t take any responsibility in this regard.
Please keep me and my family in your prayers so that my family and I get over from this emotional and social reputation turmoil. I hope and believe that I will get a breathing space among friends during the transition of social status.

Best regards,

*****

মিতুলের ১৩ দম্পতি বন্ধু একই মেইল পেলো। মেইল পেয়ে বন্ধুরা, তাদের বউরাও বিরক্ত। তারা ফোন, এসএমএস করে জিজ্ঞেস করতে লাগল “WHAT HAPPENED?” মিতুল কী জবাব দেবে। ও নিজেই বুঝতে পারছিলো না কী হয়েছে। হাজবেন্ড-ওয়াইফের মধ্যে কত ঝামেলাই তো হতে পারে। তাই বলে এভাবে কথা ছড়িয়ে বেড়ায় কেউ? মিতুল বিপদের গন্ধ পায়। হাজবেন্ডের সাথে দেখা করার চেষ্টা করে। ওদের বাসায় যায়। অবস্থা আগের মতোই। বাড়িতে গেলে দরজা খোলে না, অফিসে গেলে রিসিপশন থেকেই পিয়ন দিয়ে বিদায় দেয়। ক্লান্ত লাগে মিতুলের। আর কত চেষ্টা করবে, কীভাবে চেষ্টা করবে বুঝে পায় না। কোরবানির ঈদ গেলো। আর কদিন পর ম্যারেজ ডে। ভাবল তখন হয়ত ফিরবে। ফোন করে, এসএমএস দেয়। কোনো উত্তর নেই। অ্যানিভার্সারির দিন রেজিস্ট্রি করা চিঠি এলো। খামের ভেতর ডিভোর্স লেটার। তাতে লেখা:

১) মিতুল কখনোই সংসার করতে চায়নি। বিয়ের এক সপ্তাহ পরই সংসার করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে আর ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে অলংকারাদি নিয়ে মায়ের কাছে চলে যায়।

২) মিতুল ঘুমের ওষুধে আসক্ত।

৩) অনেক পরপুরুষের সাথে মেলামেশা মিতুলের।

৪) মিতুল সন্তানধারণে অক্ষম।

৫) মিতুল ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী স্বামীর বাধ্য হয়ে চলে না... ইত্যাদি ইত্যাদি

ডিভোর্স লেটার পাওয়ার পরে জানা গেলো মিতুলের নামে বেশ কয়েকটা জিডি করা আছে তাদের এলাকার থানায়, মিতুলের বাবার বাড়ির এলাকাতেও। মিতুল কোনো লিগ্যাল অ্যাকশন নিলেও পুলিশ আগে শ্বশুরপক্ষের কথাই শুনবে। মিতুল জানতে পারে ওরা সবখানে বলে বেড়াচ্ছে মিতুল চাইলেও নাকি কিছু করতে পারবে না। চাইলে মিতুল অনেককিছুই করতে পারে। শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। ওর সরলসোজা ভালোমানুষ মাকে কোর্টের নোংরা জেরার মধ্যে ফেলতে চায় না ও। মিথ্যে বলে জামাইয়ের দোষ বাড়িয়ে দেখানো তার কাজ নয়। মামলা মোকদ্দমায় যে ভূরি ভূরি মিথ্যে সাজানো হবে সে তো জানা কথা।

মিতুল লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়ে ওর বাবার দেওয়া জিনিসপত্র ফেরত চাইলো। তারা গা করল না। জবাব দিলো না কোনো। ওদিকে ছেলের বউয়ের বদনাম করে চলছে তখনো। মিতুল কত খারাপ, ওর মা কত খারাপ, তাদের ছেলেকে কত কষ্ট দিয়েছে এসব বলে বেড়াতে তাদের ক্লান্তি নেই। কিন্তু খারাপ বউয়ের গয়না, আসবাব ফিরিয়ে দেওয়ার বেলায় নেই। ওগুলো নাহয় গেলো। কিন্তু মিতুলের জীবনের দুটো বছর কি পারবে কেউ ফিরিয়ে দিতে?

নভেম্বর-ডিসেম্বর খুব খারাপ গেলো। মানসিক অর্থনৈতিক সবদিক দিয়েই। দুইমাসের জমানো বেতনের সাথে আরো কিছু পার্টটাইম কাজের টাকা মিলিয়ে দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া অ্যাডভান্স করলো। মা-কে নিয়ে উঠল সেখানে। বেতন কম। ১৫ হাজারের ১৩ চলে যায় বাসা ভাড়া আর অন্যান্য বিল মেটাতে। মায়ের কিছু সঞ্চয় ছিলো। এই দিয়ে ওদের চলে। মিতুল এখন ভালো আছে, শান্তিতে আছে।
ডিভোর্সে একদিক দিয়ে শাপে বর হয়েছে। মিতুল মানুষ চিনল নতুন করে। যে সম্পর্কে নিঃশ্বাস নেওয়ার জানালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, সে সম্পর্কে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এখন অন্ততপক্ষে বুকভরে শ্বাস নিতে পারে।

তবে ডিভোর্সের কারণে মানুষের অ্যালিয়েন চাহনি আর আচরণে ঘেন্না ধরে যায় মাঝেমধ্যে। ও বোঝে না ডিভোর্সি মেয়েদের আজবভাবে ট্রিট করাহয় কেন। পুরুষদের কাছে সহযোগিতা আশা করে না, কারণ ডিভোর্সি জানার পর ৯০% পুরুষই কামাতুর দৃষ্টিতে তাকায় কিংবা মনে মনে অনেককিছু করে ফেলে। কিন্তু মেয়েরা বা মহিলারাও কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকায়, আচরণ পালটে যায়। মিতুলের পরিবারে অনেক ভাবি/বোন/আন্টি আছেন যারা ওর ডিভোর্স নিয়ে যারপরনাই লজ্জিত, বিব্রত। ওর সাথে কোথা বলার সময়ও হয় করুণা কিংবা ঘৃণা নিয়ে তাকায়। অনেককিছু উপেক্ষা করে মিতুল। সবটা পারে না সবসময়। ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে একটা এতিম মেয়ের সাথে ওরা যা করল তার প্রতিদান কড়ায়গণ্ডায় আল্লাহ অবশ্যই দেবেন ওদের।

এক্স হাজবেন্ডের কথা ভেবে খারাপ লাগে এখনো। অনেক ভালোবেসেছিলো মানুষটাকে। অনেক বেশি। ঘৃণা করার রুচিও হয় না এখন।

মায়া লাগে কবরে শুয়ে থাকা বাবার জন্য যে অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে ওই পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলো। মায়া লাগে ওর মায়ের জন্য যে এখনো বিশ্বাস করতে পারে না তার জামাই এত খারাপ কাজ করতে পারে। মিতুল রাতে ঘুমিয়ে পড়লে ওর মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জেগে থাকে আর কাঁদে (মিতুলের খালা বলেছে)। এই মায়ের চোখের পানির মূল্য দেবে না ওরা? দিতেই হবে।

এতকিছু হারিয়েও মিতুলের অর্জন নেহাত কম নয়। দুনিয়ার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আর লড়ে যাওয়ার শক্তি বা সাহস হারায়নি এখনো। ওর এক্স হাজবেন্ডের পরিচিত মহলের মধ্যেই কিছু বন্ধু ও পেয়েছে যারা এই বিপদের দিনে ওর পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়েছে। এমন কিছু বন্ধু ও পেয়েছে যাদের কাছে ন্যায়বোধ ব্যক্তিগত সম্পর্কের থেকে বেশি মূল্যবান।

গত ছয়টা মাস অনেক খারাপ সময় গেছে মিতুলদের। এমনও দিন গেছে যখন বাজার করার টাকা ছিলো না। চা-বিস্কুট, মুড়ি দিয়ে দিন পার করেছে মা-মেয়ে। তারপরও কারো কাছে একটাবারও হাত পাতেনি। গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে বাইরের জগতটার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে এখনো। নিজের ভালোত্ব প্রমাণ করতে জনে জনে গুজব ছড়াতে হয় না বা মেইল করতে হয় না ওর।

মিতুলের আর কিছু হারাবার ভয় নেই এখন। বেশি কিছু চাওয়ারও নেই। এখন শুধু চায় ঈমানের সাথে যেন চলতে পারে, জ্ঞানত যেন কারো সাথে অন্যায় না করে। আর চায় একটুখানি সহযোগিতা, আশপাশের মানুশের কাছ থেকে একটু ভালোবাসা। আর কিছু না।

আর স্বপ্ন আছে নিজের একটা সন্তানের। সে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে কি না তা জানা নেই মিতুলের।


(গল্পের স্থান-কাল-পাত্র সবই সত্য। মিতুলের অনুরোধে প্রকৃত নাম, পরিচয় আড়াল করা হলো।)

No comments: