Sunday, July 23, 2017

হাজেরা বেগমের শিশুরা

হাজেরা বেগমের কথা প্রথমে বলেছিলেন জোবাইদা নাসরীন। উনি আমাদের মেয়ে নেটওয়ার্ক-এর সদস্য। সন্ধি এই মেয়ে নেটওয়ার্ক-এর একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। সন্ধি'র ব্যাপারে জেনে জোবাইদা আপা বলেছিলেন হাজেরা বেগমের পাশে দাঁড়ানোর কথা। সে সময় আমরা পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলাম। হাজেরা বেগমের সাথে তাই যোগাযোগ করতে দেরি হলো কিছুদিন। এর মধ্যে ফেসবুকে একটা ভিডিও চোখে পড়ল হাজেরা বেগমকে নিয়ে।



জোবাইদা আপা ততদিনে নিজে গিয়ে হাজেরা আপার সাথে দেখা করে এসেছেন। জোবাইদা আপার কাছ থেকে নাম্বার নিলাম হাজেরা বেগমের। ফোন দিলাম। কথা হলো। আমাদের কেউ কেউ টাকা দিতে চাইছিলো। কিন্তু হাজেরা আপা দেখা না করে টাকা নেবেন না। উনি চান আমরা যাই, বাচ্চাদের সাথে কথা বলি, ওদের সাথে সময় কাটাই। তারপর যা ইচ্ছে দেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম উনাদের কী লাগবে। হাজেরা আপা বললেন, "আপনারা যা দেবেন তা-ই আমাদের লাগবে।"

গতকাল (২২ জুলাই) আমরা তিনজন গেলাম উনার আদাবরের বাসায়। বাচ্চারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমরা ঢুকতেই হইহই করে উঠল। ছোট্ট একটা মেয়ে, বয়স তিন বা চার, আমাকে জিজ্ঞেস করল, "তুমিই কি তিসিলা আপু?"

ওর নাম হাফসা। হাজেরা বেগমের ৪০ জন শিশুর মধ্যে সম্ভবত কনিষ্ঠতম। সবথেকে বড়জন ক্লাস নাইনে পড়ে। ওরা স্কুলে যায়, সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়তে যায়, গান শিখতে যায়। আটজন আছে বোর্ডিং স্কুলে। ৩২ জন শিশু নিয়ে দুই কামরায় অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছেন হাজেরা বেগম। তাঁর নিয়মিত কোনো অর্থসংস্থান নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে সহায়তা করে উনাকে। কেউ কেউ জাকাতের টাকা দেয়। আটটি শিশুকে স্পন্সর করে একটি সংস্থা। বাকি শিশুদের নিয়ে এই বাসায় উনার মাসিক খরচ ৬৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

এখানকার শিশুদের প্রায় সবাই যৌনকর্মীদের সন্তান। হাজেরা বেগম নিজে প্রাক্তন যৌনকর্মী। এই পেশার বঞ্চনা, যাতনার অভিজ্ঞতা থেকে শিশুগুলোর ভবিষ্যত তাকে ভাবায়। তাঁর ভাবনামতে যৌনকর্মীদের সন্তানেরা সবার পিছে, সবহারাদের নিচে। এমনকি ভিখারির সন্তানেরাও স্কুলে যাবার, সমাজের অংশ হবার সুযোগ পায়। যৌনকর্মীদের সন্তানদেরকে সমাজ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে নারাজ। এই শিশুদেরকে শিক্ষা দিয়ে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে শেখাতে চান হাজেরা বেগম। যেই শৈশব তিনি নিজে পাননি, তেমন একটি সুন্দর শৈশব এই শিশুদেরকে দিতে চান তিনি।



হাজেরা বেগম যা করছেন তা রীতিমতো অসাধ্য বলা চলে। আমরা তাই উনাকে সহযোগিতা করার ঔদ্ধত্ব দেখাতে চাই না। আমাদের সীমিত সাধ্য দিয়ে বড়জোর উনার ভার সামান্য হলেও লাঘব করার চেষ্টা করতে পারি হয়ত। সন্ধি কোনো এনজিও নয়, আমাদের অনেক অনেক টাকা নেই। এটি নিতান্তই ছাপোষা কিছু মানুষের ছোট্ট একটি নেটওয়ার্ক। হাজেরা আপার সাথে কথা বলে আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি কীভাবে আমরা উনার পাশে থাকতে পারি।

এক সন্ধ্যার আলাপে যে পথগুলো পেলাম সেগুলো হলো:

(১) শিশুদের স্পন্সর করা: 
প্রতি শিশুর জন্য মাসিক খরচ ৩ হাজার টাকা। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বাচ্চাদের স্পন্সর করার ব্যাপারে খোঁজখবর করেছেন অতীতে। একজন করে শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের অনেকেরই আছে নিশ্চয়ই।

আপডেট: হাজেরা আপার সব শিশু এখন স্পন্সরশিপের আওতায় আছে।

(২) পড়ালেখার সরঞ্জাম দেওয়া:
উনাদের দরকার খাতা, কাগজ। অব্যবহৃত ডায়েরি, কাগজ কিংবা ব্যবহৃত কাগজের এক পিঠ খালি থাকলে সেটাও দিতে বলেছেন। আমাদের অনেকের অফিসে অনেক কাগজ নষ্ট হয়। অনেক ডায়েরি দুয়েক পাতা লিখে পড়ে থাকে। কারো কাছে অব্যবহৃত কিংবা অল্প ব্যবহৃত ডায়েরি থাকলে উনাদের দিতে পারেন। বাচ্চাদের দেওয়ার মতো গল্পের বই থাকলেও দেবেন। 

(৩) সরাসরি টাকা দেওয়া: 
সরাসরি হাজেরা বেগমের সাথে যোগাযোগ করে হাতে হাতে কিংবা বিকাশে টাকা দিতে পারেন। শিশুদের একটি স্থায়ী আবাস গড়তে হাজের আপা একটি জমি কিনতে চাচ্ছেন। চাইলে সেই জমির জন্য টাকা দিতে পারেন। তবে দেখা না করে, বাচ্চাদের সাথে সময় না কাটিয়ে শুধু টাকা নিতে উনি নারাজ। 

(৪) জমি কিনতে সহায়তা করা:
হাজেরা আপা শিশুদের একটি স্থায়ী ঠিকানা গড়তে চান। তার জন্য জমি কিনতে হবে। ঢাকার উপকণ্ঠে জমির সন্ধান দিয়ে কিংবা অর্থসংস্থান করে উনার ইচ্ছেপূরণে সহায়তা করতে পারেন।

(৫) শিশুদের দক্ষতা শেখানো:
ছবি আঁকা, গান গাওয়া, অরিগ্যামি বা অন্য যা কিছু পারেন গিয়ে হাজেরা আপার শিশুদের শিখিয়ে আসতে পারেন।

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। হাজেরা আপা চান উনার শিশুরা যেন ভালোবাসা পায়, আনন্দে থাকে। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া কোনো শিশুই মানুষ হয় না, এটা হাজেরা আপা খুব বোঝেন। আমরা যদি উনার শিশুদের সাথে বসে গল্প করি, ছবি আঁকি, গান গাই, এতেও ওরা খুশি হবেন। যাদের আর্থিক সাহায্য দেবার সুযোগ নেই, তারা অন্তত ভালোবাসাটুকু দিতে পারেন। আর্থিক সহায়তার থেকে তা কোনো অংশেই কম নয়। 

কেউ কেউ শিশুদেরকে নিয়মিত পড়ানোর, ছবি আঁকতে শেখানোর ব্যাপারে ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এই ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারলে কী যে দারুণ হবে তা বলার নয়। সেই সাথে এটাও ভাবতে অনুরোধ করব যে আসলেই কি নিয়মিত ওদের সময় দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব কি না। জীবনের ব্যস্ততায় কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে শিশুদের মন ভেঙে যাবে। অনেক বড় প্রতিশ্রুতি না দিয়ে এক বেলা ওদের সাথে বসে যে যা পারেন তা শিখাতে পারেন ওদের। 

সবশেষ প্রসঙ্গ। কীভাবে কার সাথে যোগাযোগ করবেন?
হাজেরা আপার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। উনার মোবাইল নাম্বার +8801712371196। উনার বিকাশ অ্যাকাউন্টও এই নাম্বারেই।

উনার ঠিকানা:
শিশুদের জন্য আমরা
হাউজ ৬/২ (দোতলা)
লুৎফর রহমান লেন
সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটি
আদাবর, ঢাকা - ১২০৭

আদাবরে গিয়ে শনিরবিল মসজিদ বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। গুগল ম্যাপে Sunibir Jame Mosque নামে পাবেন। মসজিদের সামনে গিয়ে হাজেরা আপাকে কল দিলেই হবে। 

হাজেরা আপা এবং তার সংস্থা "শিশুদের জন্য আমরা"র ব্যাপারে জানতে পারবেন উনাদের ব্রোশিওর থেকে। লিংক- https://goo.gl/vKQJYe

প্রবাসীরা সন্ধি'র পেপ্যালের মাধ্যমে কিংবা ব্যাংকে টাকা পাঠাতে পারেন। আপনার পাঠানো টাকার শতভাগ হাজেরা বেগমকে দেওয়া হবে। কেউ সশরীরে বইখাতা, কাগজ, ডায়েরি ইত্যাদি দিতে না পারলে সন্ধিকে দিতে পারেন। আমরা গিয়ে দিয়ে আসব ওদের।

বিস্তারিত জানতে সন্ধি'র ফেসবুক পেইজে মেসেজ পাঠান। তার আগে অবশ্যই সন্ধি'র ব্যাপারে ধারণা নিয়ে নিন। আমাদের চেনেন, আমাদের কাজ জানেন এবং আমাদের বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র এমন বন্ধুদের নিয়ে কাজ করে সন্ধি

সন্ধি'র ফেসবুক পেইজ: https://www.facebook.com/shondhi2013/



আপডেট (২১ নভেম্বর ২০১৭):

  • 'মেয়ে' নেটওয়ার্কের ২৪ জন সদস্য হাজেরা বেগমের ২৫ জন শিশুকে স্পন্সর করছে। বাকি শিশুদেরকে আগে থেকে স্পন্সর করছে অন্য একটি সংগঠন।
  • 'মেয়ে' নেটওয়ার্কের কিছু সদস্য এককালীন কিছু টাকা দিয়েছিলেন। হাজেরা বেগম নগদ টাকা না নিয়ে চেয়েছিলেন সেই টাকা দিয়ে আমরা তার শিশুদের জন্য একটি লকার বানিয়ে দিই। লকার প্রায় তৈরি। আশা করি এ সপ্তাহের মধ্যে দিয়ে আসতে পারব।
  • আমরা যে যতটুকু পারছি হাজেরা বেগমের বাসায় গিয়ে দেখা করছি, শিশুদের সাথে সময় কাটাচ্ছি।


আপডেট (২৪ নভেম্বর ২০১৭):
গত শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) বিকেলে আমরা কজন গেছিলাম হাজেরা আপাকে আলমারি দিয়ে আসতে। 


সে বিশাল এক দক্ষযজ্ঞ হলো। আলমারি সুন্দর হয়েছে। হাজেরা আপা এবং বাচ্চাদের পছন্দ হয়েছে। 


জিহান আপুর পাঠানো উপহার আর নাদিরা আপুর পাঠানো চকলেট পেয়ে বাচ্চারা যারপরনাই অভিভূত। 



কাদের ষ্টীল ফার্নিচারকে ধন্যবাদ বিশাল ডিসকাউন্টের জন্য। 

হাজেরা আপার শিশুদের কথা শুনে উনারা নিজে থেকে লাভ কমিয়ে এনেছেন। উনারা খুবই খুশি হয়েছেন এই কাজের সাথে যুক্ত হতে পেরে।

আপডেট (১০ ডিসেম্বর ২০১৭):
২৫ জন শিশুর ডিসেম্বরের খরচ হাজেরা আপাকে দিয়ে আসা হয়েছে।

লেখক:
Trishia Nashtaran
Originator and Coordinator, Meye Network

No comments: